মাংসপিন্ডহীন জীবন
রুমানা সোবহান পরাগ: ইশ! কি ইচ্ছা করছে আম্মার হাতের জলপাই ভর্তা খেতে। শুধু জলপাই না, কদবেল ভর্তাও খেতে ইচ্ছা করছে। ইদানীং এই এক সমস্যা হয়েছে আমার জীবনের সব সুখ খাবারের মধ্যে খুঁজি। সকালে ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় শুয়ে থেকে ভাবি কি দিয়ে নাস্তা করব। কত খাবারের কথা মনে পড়ে আজকাল। পৃথিবীর সবার সঙ্গে যোগাযোগের চাইতে খাবারের সঙ্গেই যেন যোগাযোগটা বেড়ে যাচ্ছে আমার।
এখন আমি আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। অনেক চেষ্টা করেছি সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, খাপ খাইয়ে নিতে। দিনের পর দিন নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সব ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। আমি আর পারি না এখন। আমি ভীষণ ক্লান্ত। ভীষণ।
আমার অনেক কিছু ইচ্ছা করে, প্রিয় মানুষের সঙ্গে এক বালিশে মাথা রেখে রাত ভোর হওয়া দেখতে। তার বুকে মুখ গুঁজে রেখে গভীরভাবে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে। হাজার বছর তার বিশ্বস্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ থাকতে। তার চোখের পাশে ঐ ছোট্ট তিলে আদর দিয়ে দিতে। তার কণ্ঠে শুনতে ইচ্ছা হয়-আমি যেমন, তেমন ভাবেই সে আমাকে ভালোবাসে।
একজোড়া মাংসপিন্ডের বাইরেও যে আমি একজন মানুষ এটা তার আচরণে উপলব্ধি করতে ইচ্ছা করে। এ আমার মোহ, নাকি প্রেম, নাকি নিজেকে ভুলে থাকার জন্য তাকে আঁকড়ে ধরা-জানি না। আমি শুধু জানি এ মুহূর্তে আমি তার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকতে চাই। কেন যেন ভাবতে ইচ্ছা করে একজোড়া মাংসপিন্ডের বাইরে, এই অসম্পূর্ণ অবয়বের ভেতরে যে আমি এক মানবসত্ত্বা তা সে যেন উপলব্ধি করতে পারে। সে যেন আমাকে মায়া করে।
খুব ইচ্ছা হয় ওকে গিয়ে বলি, আমি একজন মানুষ। এই মাংসপিন্ডহীন আমাকে ও ভালোবাসতে পারবে কি? বড্ড জানতে ইচ্ছা করে, বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে ওর মুখের অভিব্যক্তি। অবশ্য একুশ বছর সংসার করেও যখন রবিনকে চিনতে পারিনি, তখন এক কাল্পনিক পুরুষের কাছে এই বেয়াল্লিশ বছর বয়সে আর কিইবা আশা করতে পারি!
তারপরও ওকে নিয়ে ভাবি।
মানুষ অসুখকে বলে অভিশাপ আর আমি বলি আশীর্বাদ। এই অসুখ আমার আপনজনকে চিনতে সহায়তা করেছে। বছর দুই আগে যখন আমি প্রথম অনুভব করলাম আমার ডান স্তনে ছোট একটা চাকা। আমি দৌঁড়ে রবিনের কাছে গিয়ে বললাম আমার ভয় হচ্ছে। ও সবকিছুতেই ফান করে, তাই পাত্তা দেয়নি।
আমি ওর হাসির সঙ্গে হাসতে পারিনি। মনের ওপর অদৃশ্য এক অন্ধকার যেন চেপে বসে। কারণ প্রথমে চাকা ডান ব্রেস্টে মনে হলেও পরে খেয়াল করছিলাম দু’টোতেই অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে। ওপরের চামড়া শক্ত অনুভূত হচ্ছিল। কয়েক সপ্তাহ বাদে আমি রবিনকে ছাড়াই এক বান্ধবীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বায়োপসি করলেন। ধরা পড়ল ব্রেস্ট ক্যান্সার, অপারেশন হলো। এরপর কেমোথেরাপি। আধুনিক কেমোথেরাপির জন্য চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যাটা তেমন হয়নি। তবে কেমোথেরাপি দেওয়ার দিনগুলো ছিল ভয়ংকর কষ্টের। ভয়ংকর বিভীষিকাময়। চিকিৎসার সময়ের সেই স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। এখন ফলোআপের উপরে আছি।
ঘটনাগুলো যেন একনিমেষে ঘটে গেল। বুঝে ওঠার আগেই পাল্টে যাচ্ছিল আমার জীবনের একেকটা দৃশ্যপট। এই অসুখের সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার জীবনেরও ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই, বায়োপসি হয়ে গেল। ব্রেস্ট বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে আমিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম আমার চেনা পৃথিবী থেকে।
পাল্টে গেল আমার চিরচেনা বেডরুমের দৃশ্যপট। আমার পুরো বাসার দৃশ্যপট। অথচ কিছুদিন আগেও সব অন্যরকম ছিল। আমি ছেলে দুটোকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি, কোচিংয়ে যাচ্ছি। রাতে চারজন মিলে ডিনার করছি। সবকিছুর একটা সুর তাল লয় ছন্দ ছিল। বাসাটাতে হাসির আওয়াজ গমগম করত।
অথচ একটা অসুখ এ বাসার সব দৃশ্যপট পাল্টে দিল।
এখন রবিন দেরি করে বাসায় ফেরে। বাচ্চারা তাদের অসুস্থ মায়ের কাছে বসে থেকে সময় কাটানোর চাইতে ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ইন্সটাগ্রামে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে।
রাতে খাবার টেবিলে দু-চারটা কথার পর রবিন ড্রয়িংরুমে ল্যাপটপে মুখগুঁজে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গেস্ট রুমে ঘুমায়। বেশ কিছুদিন পর আমি নিজে সংকোচ কাটিয়ে ওকে বেডরুমে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। এসেছিল তবে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিল। আমি সাহস পাইনি আর ওকে ছুঁতে সেদিন। লজ্জায় ঘৃণায় আমি কুঁকড়ে গিয়েছিলাম সেই রাতে। এরপর থেকে আমি আর ডাকিনি ওকে। নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ একেকটি রাত আমি একাই পার করি। কখনো সারা রাত হেঁটে, কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনাবৃত আমাকে আয়নায় দেখে। আয়নায় দেখি আমার ক্ষতবিক্ষত দেহকে। দেখি ক্ষতবিক্ষত জীবনকে। সামান্য দু’টো মাংসপিন্ডের অভাবে আমি কেমন আমার কাছেই অচেনা হয়ে গেছি।
উষ্ণতা, আদর, আলিঙ্গন ছাড়া এই পৃথিবীটা বড় বিবর্ণ রবিন। আমি আর তোমাকে আমার ভাবনার জগতে আসতে দেই না। কল্পনায় আমি এক স্নেহশীল পুরুষের সঙ্গে রাত্রিযাপন করি। প্রতিটা রাতে তার শক্তবাহুতে নিজেকে অনুভব করি। আমি তার চোখের পাশের ছোট্ট তিলটার কথা ভেবে রাত ভোর করি। আমি আর বাস্তবে না, কল্পনাতেই বসবাস করি। একজোড়া মাংসপিন্ডহীন এক অন্যরকম মানবজীবন আমি যাপন করছি, রবিন। - সংগৃহিত