সময়টা একেবারেই ভাল যাচ্ছে না!
প্রকাশের সময় : 2019-11-06 20:08:27 | প্রকাশক : Administration

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ স্বস্থি পাচ্ছি না কিছুতেই। কোন কিছুতেই পাচ্ছি না। আমার শোনিমকে দূরে রেখে কোন কালেই স্বস্থি পাইনি। আজো পাচ্ছি না। সারাদিনের শত ব্যস্ততার পরেও ঘরে ফিরে ওর মুখটি না দেখলে ক্লান্তি কমে না, অবসাদ কাটে না। কিন্তু নিয়তি কি অতসব বুঝে! বুঝে না। নিয়তি চলে নিয়তির গতিতে। দিনদিন ছেলে আমার বড় হচ্ছে আর জীবনের প্রয়োজনে কেমন করে যেন আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। নিয়তির টানেই যাচ্ছে।
নিয়তি কেবল আমার সময়টাকেই অস্থির করেনি। পুরো দেশের সময়টাকেই যেন অস্থির করে দিয়েছে। গেল কয়েক মাসে অস্থিরতা কমছেই না। একের পর এক ইস্যু আসছেই। একটা যেতে না যেতে আর একটা আসছে। প্রথমে এলো ছেলেধরা এবং শিশুর কাটা মাথা ইস্যু। শুরুতে পাত্তা দেইনি। এমন আজগুবি ইস্যুকে পাত্তা দেবার কোন কারণও তো নেই। পরে দেখলাম পরিস্থিতি মোটেই পাত্তা না দেবার মত নয়। সংঘবদ্ধ চক্র আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। লোকমুখে চাউর করিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতুতে রক্ত লাগবে। মানুষের তরতাজা রক্ত।
চারদিকে রক্ত ঝরতে শুরু করলো। মাথা পড়তে শুরু করলো। তাজ্জব কান্ড। যেন বিভীষিকার রাজ্য। অল্প সময়েই বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়লো দেশের আনাচে কানাচে। ষড়যন্ত্র সফল হলো। পদ্মা সেতু নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের যেন শেষ নেই। কয়েক বছর আগের বিশ্বব্যাংকের কাগুজে ষড়যন্ত্রের পর এবার শুরু হলো রক্তাক্ত ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের মন্ত্র হলো গুজব। গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে দেয়া। মানুষকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলা। এবারও গুজব সফল হলো। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় মানুষ গুজবকেই বিশ্বাস করতে শুরু করলো। শেষমেষ টনক নড়লো সরকারের এবং প্রশাসনের ঘাম ঝরিয়ে অবশেষে পরিস্থিতি অনুকূলে আনা গেল। জাতি তথা দেশ আপাত রক্ষা পেল ভয়াবহ গুজবের থাবা থেকে।
মুশকিল হলো এটা আপাত রক্ষা। পরবর্তী গুজব চাউর হওয়া পর্যন্ত রক্ষা। গুজব থেকে এ জাতির স্থায়ী মুক্তি নেই। উন্নতিও নেই। বাঙালি জাতির উন্নতি হবে সেইদিন, যেদিন এমনতর গুজব থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারবে। ছেলেধরা গুজবে বেশ কিছু মানুষের প্রাণ যাবার পর দেখলাম অনেকেই সতর্কতামূলক পোস্ট করেছিল, আমরা আর গুজবে কান দিব না বলে। কিন্তু বাস্তবতায় কতটুকু করতে পেরেছি?
গুজব বাংলাদেশে নতুন কিছু না। এটা আদিকাল থেকে শুরু করে এখন অবধি চলমান আছে। যে ২০০ বছর আমরা বৃটিশদের গোলামী করলাম, তার পিছনেও ছিল একটি অত্যন্ত চতুর গুজব। বৃটিশরা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়, নবাবের অন্ধকূপ আছে। এবং নবাব মানুষ মেরে মেরে সেই কূপে ফেলছে। গুজবটা এতই শক্তিশালী ছিল যে অল্প কিছুদিনেই নবাবের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং যুদ্ধের পর নবাব তেমন কোন সাহায্যও পাননি। বরং মানুষ বৃটিশদের আরো স্বাগত জানায়। পরবর্তী ২০০ বছর আমরা বহু মাথা চাপড়েছি। ভাল করেই বুঝতে পেরেছি, নবাবের কোন অন্ধকূপ ছিলনা, সব গুজব। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।
একবার দু’বার নয়, এমনি সর্বনাশ বহুবার এ জাতির হয়েছে। কেবল এ থেকে শিক্ষাটা হয়নি। কোন ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশে যে স্পিডে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, রকেটের স্পিডও তার কাছে হার মানে! যে দেশটাতে শিক্ষার হার বর্তমানে খুব একটা খারাপ নয়, সে দেশটাতে কিভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে তা সত্যি অবাক করা একটি বিষয়! বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারী অধিকাংশ মানুষই কোন ইস্যুর সত্যতা না জেনেই মজার চোটে গুজবে কান দেয়।
ভীষন মজা। কোন গুজবের সত্যতা না জেনে অযথা ভাইরাল করে আমরা আসলেই মজা উপলব্ধি করি। একবারও ভাবি না এসবের পরিণতি কী ভয়াবহ রূপ লাভ করে! ক’দিন আগে বর্তমান বাংলাদেশের জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রীর নাম করে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকে গুজব ছড়ালো। কিন্তু আমরা কেউই জানতাম না এটা আসলেই সেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী নয়; অন্য কেউ!
গুজব রটনাকারী কিংবা এতে বিশ্বাস পোষনকারীরা একটুও ভাবী না, গুজবে করা এই একটি মারাত্মক ভুলে একটি মানুষ তথা তার পরিবার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। আপনার হাতে একটা স্মার্ট ফোন আছে; তার মানে এই নয় যে আপনি যাকে খুশী তাকে ধ্বংস করে দেবেন। কাউকে ধ্বংস করার অধিকার তো আপনাকে কেউ দেয়নি। আপনাকে স্মার্ট ফোনের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। আপনি পজিটিভ মজা করতেই পারেন। কিন্তু কাউকে অযথা হেয় করে মজা লুটতে পারেন না!
ঢাকা শহরের কোন ছেলেকে দেখেছেন চিৎকার করে বলতে, “মাইয়াটা খুব সেক্সি। লিংক বাইর হইছে। ৪ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের। লাগবো মামা?” বলতে দেখেন নাই। কারন কি জানেন? আশেপাশের মানুষেরা থাপরায়া সোজা বানিয়ে দিবে তাকে। কিন্তু এই ছেলেগুলো ঠিকই ফেসবুকে নিজের আইডি থেকেই এইসব পোষ্ট বা কমেন্ট করে বেড়ায়। কারণ, ফেসবুকে ওদের থাপরানো খেয়ে সোজা হবার ভয় নেই। আবার কেউ থাপরাতে আসেও না। থাপরানোর বদলে উল্টো মজা নিতে আসে।
মজা নিতে আপনিও আসেন; আমিও আসি। যেন মজা করা আমাদের মজ্জাগত। মজা আমরা পেঁয়াজ নিয়েও নিয়েছি। বলা কওয়া ছাড়া ক’দিন আগে ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানী বন্ধ করে দেয়। কাজটি ভারত মোটেই ঠিক করেনি। আমাদেরকে কিছুটা হলেও সময় দেয়া দরকার ছিল। অন্তত ১৫টা দিন আগে বলা জরুরী ছিল। বলেনি। তাই এটা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করা যেত। প্রতিক্রিয়া দেখানো যেত।
আমরা তা দেখাইনি। দেখাবো কোন মুখে! ভারত ছাড়া আমাদের উপায় আছে! পেট ব্যথা হলেও ভারতে দৌঁড় দেই। ছেলে মেয়ের বিয়ে, গয়নাগাটি দরকার। কোথায় আর যাবো! ভারত! বিয়ে শেষে হানিমুন। সেটাও ভারত। দেশে দম বন্ধ হয়ে আসছে; মুক্ত বাতাস দরকার! চলো ভারতে যাই। দেশের চ্যানেলে নির্মল বিনোদন নেই! ভরসা ভারতীয় চ্যানেল। জিটিভি আর স্টার চ্যানেল থেকে চোখ সরে না। রাতেও চোখ ভারতে, দিনেও ভারতে। এসব মজা রেখে ভারত বয়কটের সাহস দেখাবো কিভাবে। দেখাতে পারিনি। দেখিয়েছি খাসিলতগত প্রতিক্রিয়া।
খাসিলতগত কারণেই পেঁয়াজ কেনার জন্যে হুমরি খেয়ে পড়েছি। পেঁয়াজের বড় ক্রাইসিসটি ছিল মাত্র চারদিনের। বড় মাত্রায় আতঙ্ক ছিল ঐ চারদিন। একটু ধৈর্য্য ধরতে পারতাম; একটু সহ্য করতে পারতাম। বড় জোর চারদিন পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারতাম। এমন তো নয় যে বাজারে পেঁয়াজই ছিল না। পেঁয়াজ ছিল। ঘরেও ছিল, বাজারেও ছিল। যত্রতত্রই ছিল। শুধু দামটা ছিল অস্বাভাবিক বেশী। এখনো বাজার বেজায় চড়া। একটি পরিবারে পেঁয়াজ লাগে মাসে ৫ থেকে ১০ কেজি। অথাৎ আমরা মাসিক ২০০ থেকে ৪০০ টাকার বাড়তি ঝামেলায় পড়েছি।
এটা একটা টাকা হলো! এটার জন্যেই এত টিটকারী, এত ফাজলামো! এত হায় হুতাশ? প্রকৃত ক্রাইসিসটা বুঝলাম না। বোঝার চেষ্টাটুকুও করলাম না। দলবেঁধে হায় হুতাশ শুরু করে দিলাম। মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেট চালানোর সময় তো হুতাশ দেখি না। ফ্ল্যাক্সিলোড করার সময় হাপিত্তেস দেখি না। তখন ২০০ তো ভাল, ২০০০ গেলেও নির্বিকার থাকি। তখন মনে হয় না বাঙালীর অভাব আছে। বাঙালীকেও হিসেব করে চলতে হয়।
এটাও আমাদের একটা স্বভাব। সব সময় উল্টো পথে ভাবি, উল্টো পথে হাঁটি। এ যাত্রাও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কিংবা আমরা ব্যবহারকারীগণ টোটালি উল্টো পথে হাঁটলাম। আমরা ব্যবহারকারীগণ ঝাঁপিয়ে পড়লাম বস্তাভর্তি পেঁয়াজ কেনায়। আর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীগণ শুরু করলো মজুদদারী। ফলে হুহু করে দাম বাড়লো। আমরা উল্টো পথে হেঁটে পেঁয়াজ না কিনলে ক্রেতার অভাবে পেঁয়াজের পচন ধরতো। অসাধু ব্যবসায়ীরা পথে বসতো।
কিন্তু আমরা তা করলাম না। ভুলটা নিজেরাই করলাম এবং বরাবরের মত দোষটা অন্যকে দিলাম। স্বজাতির কিংবা নিজের ব্যক্তিগত ভুল দেখলাম না। ভুল দেখা কিংবা অন্য মানুষের ভুল ধরা মানব জাতির আদিম স্বভাব। আর বাঙালী হলো এই কাজে আরো এক কাঠি উপরে। সুযোগ পেলেই ভুল ধরে। তবে কখনোই নিজেরটা নয়; সব সময়ই অন্যেরটা ধরে। নিজেরটা ধরবে কি? নিজের ভুল তো দেখাই যায় না। ভুল হলো পাছার মত। কখনো নিজেরটা দেখা যায় না। সব সময় অন্যেরটা দেখা যায়।