এখন ভাল আছি! বেশ ভাল!!
প্রকাশের সময় : 2019-11-21 12:12:18 | প্রকাশক : Administration

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বেশ মানে, ভয়াবহ রকমের বেশ। নিয়ন্ত্রণহীন খিটখিটে মেজাজ, আর চট করে ক্ষেপে যাওয়া দেখে নিকটজনেরাও ভড়কে গিয়েছিল। বেশী ভয় পেয়েছিল আমার শোনিমের আম্মু। কথায় কথায় আমাকে বালিশে মাথা রাখতে দেখেই তার ভয় পাওয়া। যে মানুষটি পারতপক্ষে বিছানায় যেতে চায় না, সেই কিনা পারতপক্ষে বিছানা ছাড়তে চায় না। মানসিক এবং শারীরিক এতটা দূর্বলতা দেখে বুঝে উঠতে পারছিল না কী করা উচিত। নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। কেবল বিছানায় শুইয়ে সরাসরি রক্তে স্যালাইন দিতে বাকী ছিল। কোন কাজে শক্তি পাই না; মন দিতে পারি না। মনের মধ্যে সারাক্ষণ অস্থিরতা। দম আসে আর যায়। সাথে বুক কাঁপাকাঁপি আর মাঝে মাঝে ধরফরানী তো আছেই।
মেডিকেলের ভাষায় এই রোগের কী নাম, কে জানে। হয়ত নাম নেই, হয়ত আছে। তবে থাকলেও আমি জানি না। আমার জানার কথাও না। আমি জানি কেবল রোগের উৎস; জীবন শেষ করে দেয়া ভয়ানক এই রোগের মূল উৎস। কেউ কেউ না মানলেও বলতে দ্বীধা নেই, খুবই ভয়ংকর এই উৎসটি হলো তথাকথিত সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফরম; সর্বনাশা ফেসবুক।
যে বুক বা বইয়ের মধ্যে চেনা-অচেনা, জানা-অজানা এবং খারাপ-ভাল সবাই তথাকথিত বন্ধুর মর্যাদা পায়, সবার ফেসকে একত্র করে রাখা যায় এবং চাইলেই মূহুর্তের মধ্যে ফেস টু ফেস হওয়া যায়, তাকেই ফেসবুক বলে। এটা আমার দেয়া সংজ্ঞা। ভাবনা আর প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার অসীম আধার এই ফেসবুককে এভাবে হেয় করে সংজ্ঞায়িত করা ঠিক হলো না হয়ত। কারণ দোষটা ফেসবুকের নয়। দোষটা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের। তবে দোষ যারই হোক, পরিস্থিতি এখন দোষাদোষীর নয়। পুরো বাঙালী জাতি এই রোগ তথা ফেসবুক সিনড্রোমে এখন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। আতঙ্কিত হবার মতই অসুস্থ।
অসুস্থতা ঘরে ঘরে আর আতঙ্ক চারিদিকে। আতঙ্কে বিদিশা হচ্ছে মস্তিষ্ক; মানুষের মস্তিস্ক। আপাতদৃষ্টিতে সীমাহীন ক্ষমতাশীল মনে হয়। কিন্তু সেই মস্তিস্কেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক কিছু নিতে পারে; ধারণ করতে পারে। কিন্তু সবকিছু পারে না। সাধারণভাবে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ তার মস্তিস্কে ঘরে বাইরের অনেক প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় সহজেই ধারণ করে। এটাকে কখনোই মস্তিষ্কের বোঝা বলে মনে হয় না। কিন্তু ফেসবুক সে সবকে ছাড়িয়ে গেছে। ফেসবুক সমগ্র দুনিয়ার সব ইস্যুকে বোঝার মত চাপিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। যা দেখতে চাই কিংবা শুনতে চাই, এবং যা কোনভাবেই দেখতে ও শুনতে চাইনা, সে সবকেও ফেসবুক সামনে তুলে ধরছে।
প্রতিনিয়ত তুলে ধরছে। ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতে কী নেই! টাইম লাইনে একের পর এক সব আছে। ঘুমুতে যাবার আগে জনপ্রিয় এবং গ্রহনযোগ্য বক্তাদের ওয়াজ শোনার চেষ্টা করতাম। প্রথম কয়েকদিন ভালই ছিল। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লাগলো। নানা মত এবং বিপক্ষ পথের বিশিষ্টজনদের ওয়াজের ঝাঁক। নিজের অজান্তেই একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে মেতে উঠেন। আমার মত খুব কমজানা মানুষদের হয় সমস্যা; মহা সমস্যা। কার কথা শোনবো, কারটা মানবো! তারা আলেম; ওলামায়ে কেরাম। সম্মানীত জন। তাদের সবার কথার যুক্তিই আপাত অকাঠ্য মনে হয়।
অকাঠ্য মনে হয় রাজনীতির খবরকেও। রাজনীতি, মানে অপরাজনীতি। সত্যমিথ্যা মিলিয়ে এবং রংচং গিলিয়ে জনতাকে ভুল বোঝানো এবং ভুল বার্তা দিয়ে খোঁচানো ছাড়া এখানে আর কিচ্ছু নেই। লক্ষ্য একটাই জনতাকে মিসগাইড করে উত্তেজিত করা। চরমভাবে উত্তেজিত করে মাঠে নামানো। এতে জনতা যে উত্তেজিত হয় না, তাও নয়। জনতা প্রবল বেগে উত্তেজিত হয় বটে কিন্তু মাঠে নামে না। জনতাও টাইম লাইনে বসেই উত্তেজনা দেখায়। ডিজিটালের হাওয়ায় রাজনীতির মাঠ কখন যে বদলে ফেসবুকের টাইম লাইন হয়েছে সেটা বোধ করি অপরাজনীতির হোতারা এখনো বুঝতে পারেনি।
পারলে এসব করতো না। গুজবও ছড়াতো না। গুজব ছড়ানোর কৌশলও এখন পরিষ্কার। গুজব সত্য ঘটনা নিয়েও ছড়ায়; আবার মিথ্যে দিয়েও। কোন সত্য ঘটনা ঘটার পর প্রথমে এ নিয়ে বেশ লাফালাফি হয়। আমজনতা চোখ ফেলে। সচেতন চোখে পরিস্থিতি অবলোকনও করে। কিন্তু পরিস্থিতি যখনই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন শুরু হয় গুজব। ঘটনায় রং মাখানো হয়। মানে ঘটনাকে শেষ করতে দেয়া যাবে না। কখনো কখনো ঘটনা ঘটে যাবার পরে একে পুঁজি করে গুজব ছড়ায়। আবার কখনো ঘটনা ঘটানো হয়। মেলা দিন যখন ঘটনা ঘটে না, তখন প্লান করেও ঘটানো হয়।
দুঃখজনক হলো, গুজব বিশ্বাস করে মোটামুটি সবাই। আর করে বলেই আতঙ্ক জন্ম নেয়। আতঙ্ক তৈরী করার আরেকটা মোক্ষম মহা অস্ত্র হলো হ্যাকিং করা। হ্যাকিং শব্দটা বোঝে না এমন মানুষ এখন সারা বাংলায় নেই। কি শহরে কিংবা গ্রামে; সবাই বোঝে। বাচ্চারাও বোঝে। দুই কিসিমের মানুষ হ্যাকিং এ জড়াচ্ছে। এক কিসিমের হ্যাকার মানুষের আইডি হ্যাক করে সামান্য টুপাইস কামানোর জন্যে। পয়সা পেলেই আইডি ফেরত দেয়। এটাও একটা বিড়ম্বনা। তবে বিপদ নয়।
কিন্তু, শুধু বিপদ নয়; মহা বিপদ হলো আইডি হ্যাক করে কারো মান ইজ্জত শেষ করা কিংবা অন্য ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দূর্বলতা এবং বিপদজনক জায়গা হলো এই দু’টো। কারো ব্যক্তিগত জীবন তছনছ করার জন্যে এর চেয়ে সর্বনাশা টুলস আর কী হতে পারে! কিংবা সমাজ তথা পুরো রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার জন্যে এর চেয়ে জঘন্য হাতিয়ার দ্বিতীয়টি কি আছে?
আর এসবের বাইরে আছে নুডিটি! অনুমতির তোয়াক্কা করে না। চোখের সামনে পুটপাট হাজির হয়। চাইলেও হয়, না চাইলেও হয়। সুরসুরি দিয়ে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে বিশ্রীভাবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। এখানে রুচি কিংবা কোয়ালিটির কোন বালাই নেই। কোন রকমের একটা হলেই হয়। চোখ আটকে যাবেই। আটকাবে না কেন? মানব সভ্যতার আদিম প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ এটি। জাগতিক নিয়মেই আটকাবে। এটা এমনই এক জিনিস যা একাকী নির্জনে চোখের সামনে পড়লে একবার না দেখে চোখ বন্ধ করে রাখার মত মুরোদ অনেকেরই থাকে না।
এমনি সব নগ্নতার হাতছানি, মিথ্যার পেচপেচানি আর জঘন্যাচারের পেরেশানীর উর্বর ভূমি এই ফেসবুক। ধর্মের মত পরম সত্য ও পবিত্র বিষয় থেকে শুরু করে অধর্মের মত চরম মিথ্যে ও অপবিত্র সব কিছু প্রতিদিন একই জায়গায় একসাথে দেখতে দেখতে মানুষের মস্তিষ্ক আউট অব অর্ডার হয়ে যায়। আমারও হয়েছিল। একটি মস্তিষ্কের এত জ্বালাতন সহ্য করার ক্ষমতা তো নেই। তাই কখন যে নিজের অজান্তে আস্তে আস্তে কঠিনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। শুধু আমি কেন, যার সাথেই শেয়ার করেছি সবাই সহমত পোষণ করেছে।
করবে না কেন? বাস্তব সমাজে অবাধে মেলামেশা করা ঠিক না। বাছবিচার করে চলতে হয়। ফেসবুক হলো বাছবিচার না করে অবাধে মেলামেশা করার ভার্চুয়াল জায়গা। এভাবে অবাধ মেলামেশা করলে যা হয়, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ঠিক তাই হয়েছে। বাস্তবের আমি যা, কিংবা যে সমাজে যাদের সাথে যেভাবে বিচরণ করি, ফেসবুক ঠিক তা নয়। ফেসবুকের সমাজ ভিন্ন, আচরণ ভিন্ন এমনকি আমিও ভিন্ন। আজকাল বাস্তবের আমি আর ফেসবুকের আমাকে মিলাতে পারি না। ফেসবুকে যারা আমাকে পায়, বাস্তবে তারা আমাকে পায় না। বাস্তবে যাদের আমি চাই, ফেসবুকে তাদেরকে পাই না।
এমনি সব হিসেব না মেলা অসঙ্গতি নিয়েই ফেসবুকের পথচলা। আর ঐ পথের পথিক হয়ে আমারও রোগাক্রান্ত হওয়া। তিন বছর ছিলাম এই পথে। হয়ত বেশী দিন নয়। তাতেই কাবু হয়ে গেছি। এবং যারপরনাই বাঁচার পথ খুঁজেছি। নানাভাবে খুঁজতে যেয়ে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন পথ পাইনি। ছেড়ে দিয়ে এখন আমি ভাল আছি। অনেক ভাল। প্রিয় পাঠক! আপনারা আমার মত চেষ্টা করুন। ভাল থাকবেন। অনেক অনেক ভাল!!
