প্রকাশের সময় : 2021-11-17 15:22:37 | প্রকাশক : Administration

বহুদিন পরে, প্রশান্তের পাড়ে!!! (পর্ব-১)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন

 

প্রায় দুইবছর পরে প্রশান্তের পাড়ে ফেরা! বড় চেনা, বড় জানা এই পাড়। জীবনের অর্ধেক সময় কাটানো এই পাড়ে। সাধারণত কখনোই এতটা গ্যাপ দিয়ে এখানে ফেরা হয় না। গ্যাপ কম দিয়ে বছরে বেশ কয়েক বার ফেরা হয়। বছরে বেশ কয়েকবার ফেরা হয়। ব্যবসায়িক কারণেই ফেরা হয়। তবে এবারের বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। বাধ্য হয়েই না ফেরা বা বলা যায় ফিরতে না পারা। ফিরি ফিরি করেই করোনার কারণে ফিরতে পারিনি। ফিরতে দেয়নি নির্মম করোনা।

ফেরার সময় পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকা থেকে যাত্রার শুরুটি কেমন হবে এ নিয়ে শংকায় ছিলাম। শংকার মূল কারণ কাগজপত্র। করোনার দুই বছরে ভিসাসহ নানা কাগজপত্র এমনিতেই উল্টাপাল্টা হয়ে আছে। উল্টাপাল্টা কাগজপত্র দিয়ে আর যাই হোক বিদেশ যাওয়া যায় না। তাই যোগাযোগ করলাম এমব্যাসীতে। এমব্যাসী সমাদর করলো। অভাবনীয় সাড়া পেলাম। তাঁদের সহযোগীতায় যা কিছু ঠিক করার, সবই করলাম; শুধু একটা ছাড়া।

ওটা এমব্যাসীতে করা সম্ভব না। গন্তব্যের দেশে যেয়ে করতে হবে। এটাই আইন। খুব সাধারণ আইন। তবে পথে পথে থাকা বাংলাদেশসহ ট্রানজিট দেশের ইমিগ্রেশন এই আইন বুঝেও না বোঝার ভান করবে কি না তা নিয়ে নতুন শংকায় পড়লাম। পড়লাম দূর্ভাবনায়। উল্টাপাল্টা কাগজপত্র নিয়ে পথে পথে হয়রানি ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছে যাবো এটা ভাবার কথাও না। ভাবিওনি। ভাবার সাহসই পাইনি।

তবে আমার শোনিমের অবস্থা ভিন্ন। ও এসব ভাবাভাবিতে নেই। খুবই একসাইটেট। জন্মভূমিতে ফিরতে কার একসাইটেশন না থাকে। তবে ভয়ও আছে। হঠাৎ আবার করোনা বাড়ে কি না, হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যায় কিনা। দুই বছরের করোনাকে এত্তটুকুন ছেলে কম তো আর দেখলো না। ওর ভয়মাখা টেনশান দেখতে দেখতে আর করোনার পিসিআর টেস্টসহ সবকিছু গোছগাছ করতে করতে যাত্রার সময় হয়ে এল। জাপান যাত্রা। গেল ছাব্বিশ বছরের গদবাঁধা নিয়মের যাত্রা।

ঢাকা এয়ারপোর্টের ছিমছাম পরিবেশ ভালই লাগলো। করোনাকালেও যাত্রী নেহায়তই মন্দ নয়। গিজগিজ না করলেও টার্মিনাল লোকে টইটুম্বুর। ভিতরে বাহিরে সর্বত্র। সর্বত্র কড়া পাহারা। মুখে মাস্ক না থাকলেই কেউ না কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছে। এবং বিদায় দিতে আসা লোকজনকে টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার সুযোগ দিচ্ছে না। তাই বাইরে থেকেই সবাইকে বিদায় দিয়ে লাগেজ স্ক্যানিং করে ভিতরে এলাম।

এয়ার লাইন্সের চেকইন কাউন্টার চমৎকার ভাবে সাজিয়েছে। আগের মত গেলাম আর চেকইন করে ফেললাম, ঠিক তা নয়। শুরুতেই চেকইন করে না। চেকইন কাউন্টারের পাশেই দুটো আলাদা কাউন্টার বসিয়েছে উল্টাপাল্টা কাগজপত্র ঠিক করার জন্যে। এখান থেকে দায়িত্বরত কমকর্তা হটলাইনের মাধ্যমে যাত্রীদের স্বস্ব গন্তব্যের এমব্যাসীতে মেইল করে, কাগজপত্র পাঠিয়ে তাঁদের মতামত নেয়। এমব্যাসীর মতামত পজিটিভ হলেই সিলছাপ্পর মেরে বেঠিক কাগজকে সঠিক করা হয়। তারপর শুরু করে চেকইন।

এমন অভাবনীয় ব্যবস্থাটি দেখে মনটা ভরে গেল। কেটে গেল মনের শংকাও। সাধারণত এমন অবস্থা এদেশের এয়ারপোর্টে খুবই বিরল। তাই যতটুকু খুশি হবার তার চেয়েও ঢের খুশি হয়ে সাথে থাকা লোকদের কাছে ব্যবস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করলাম। বললাম, করোনা আর কিছু না পারুক, দেশের এয়ারপোর্ট ব্যবস্থাপনায় সাংঘাতিক ভূমিকা রেখেছে। পোর্টের বাঙালীকে মানুষ বানিয়ে ছেড়েছে।

তবে ভুলটা ভাঙতে সময় লাগলো না। খুব তাড়াতাড়ি একজন অমানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেই না ইমিগ্রেশানে গেলাম, অমনি মুখ ভেংচী। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে আমরা কেন বিদেশীদের কাউন্টারে আসলাম এই নিয়ে ইমিগ্রেশান অফিসারের মুখ ভেংচানো। প্রথমে কিছুটা বিব্রত হলেও ইশারায় তার মাথার উপর থাকা ডিজিটাল বোর্ডটি দেখিয়ে বললাম, জনাব! খামাখা আমাদের উপর মনোক্ষুন্ন হচ্ছেন। কোন ভুল হয়ে থাকলে সেটা আপনাদের কেউ করেছে। আমরা করিনি। বিদেশীর পাশে প্রবাসী কথাটা জ্বালিয়ে রেখেছেন আপনাদেরই কেউ।

আড়চোঁখে ওটা দেখে বুঝতে পারলেন, মাইনকা চিপায় পড়েছেন। বেজায়গায় বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন। কিন্তু তাতে কি? তিনি ইমিগ্রেশান অফিসার। যাত্রীর কাছে হেরে যাবার পাত্র নন তিনি। জিততেই হবে তাকে। পাশাপাশি মনের ঝালও মিটাতে হবে। ইজ্জতওয়ালা মানুষের ইজ্জত বলতে কথা। এবার তিনি আমার কাগজপত্র দেখা শুরু করলেন। সবশেষে একেবারে অপ্রয়োজনীয় একটা ডকুমেন্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ দেখে হাতে মওকা পেলেন।

মুখের কোণে তৃপ্তির হাসি। বললেন, নো ওয়ে। আপনাদের অনবোর্ড করা যাবে না। ডকুমেন্টের মেয়াদ শেষ। আমি জানতাম তিনি ঠিক এ জায়গাতেই আমাকে আটকিয়ে ফাজলামোর শুরুটা করবেন। আমি বললাম, এখন করোনা কাল। শুধু আমি কেন! সবার নানাবিধ ডকুমেন্টের মেয়াদ শেষ। এমব্যাসী এর মেয়াদ বাড়াতে পারে না। জাপান যেয়ে বাড়াতে হবে। কথাটি এমব্যাসীই আমাদের জানিয়েছে। আর এই ডকুমেন্টটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু একমাত্র প্রয়োজনীয় যে প্রপার ভিসা, সেটার মেয়াদ আছে। সমস্যা কোথায়?

কথাটা তার মনোঃপুত হলো না। ভেগর ভেগর মনে হলো। সেটা বোঝা গেল তার মুখের তাচ্ছিল্যমাখা আদল দেখে। খুবই তাচ্ছিল্যভরে পাসপোর্ট তিনটি হাতে ধরিয়ে বললেন, বড়বাবুর কাছে যান। আমার কিচ্ছু করার নেই। বড়বাবুর দল ইমিগ্রেশানেরই এক চিপায় বসা ছিলেন। গাদাগাদা পাসপোর্ট নিয়ে তারা বসে আছেন। কঠিন ভীড় সেখানে। অসহায় মানুষের দল আকুতি মিনতি করছেন। দয়া ভিক্ষা করছেন। কোন রকম ভীড় সামলে আমরাও তাদের সামনে দাঁড়ালাম দয়া ভিক্ষার জন্যে।

মেয়াদ ছাড়া কিভাবে ছাড়বো আপনাদের? তার সোজা সহজ এবং মিষ্টিমাখা জটিল প্রশ্ন। যেভাবে চেকইন কাউন্টারের বিশেষ টিম এমব্যাসীর সাথে কথা বলে যাচাই বাছাই করে আমাদের পেপারে সিল মেরে ছেড়েছেন ঠিক সেভাবেই ছাড়বেন; আমারও ডাইরেক্ট উত্তর। কিন্তু আমাদের কাছে তো যাচাই বাছাইয়ের কোন সিস্টেম নেই। আমরা কিভাবে নিশ্চিত হবো? তার মিন মিনে জবাব। একই জিনিস ঘাটে ঘাটে থাকা বিভিন্ন টিমের নিশ্চিত হবার দরকার কি? আমার ত্যাড়া উত্তর। তিনি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন মনে হলো। আর খুব বেশি দরকার হলে আপনি ওদের কাছে যান। ওরাও তো সরকারী লোক। আমি যোগ করলাম।

কথার পাল্টা কথার জবাবে খুব কাজ হলো। তিনি আর কথা খুঁজে পেলেন না। পেলেন না হয়রানী করার বাড়তি কোন সংলাপ। অগত্যা হাসতে হাসতে সাইন করে ছেড়ে দিতে দিতে বললেন, দিয়ে দিলাম। আমাদের জন্যে দোয়া কইরেন কিন্তু। বুঝলাম, আমাকে দয়া করার সুযোগ না পেয়ে নিজেই দয়া চাইছেন, দোয়া চাইছেন। হায়রে বাঙালী!

পাঁচ ঘন্টা জার্নির পর ট্রানজিট নিচ্ছি কাতারের দোহা বিমান বন্দরে। উল্টো পথে যাত্রা। কিচ্ছু করার নেই। করোনায় বেশির ভাগ রুটই বন্ধ। কিন্তু দোহার অফিসাররা অন্ধ নয়। তাদের ব্যবহারে ছন্দ ছিল। এমনিতে ওরাও জটিল। কাগজপত্র নিয়ে মোটামুটি জেরা করে। ভিসা ঠিকঠাক আছে কিনা, খুব ভাল করে পরখ করে। এবার কিছুই করলো না। করবে কেন? এবার তো আর সেবার নয়। এবার করোনার বার। করোনায় পুরো পৃথিবী এলোমেলো। এখন মানুষ না বদলালে পৃথিবী বদলাবে কেমন করে?

কাতার থেকে টানা ১২ ঘন্টার জার্নির পর জাপান ল্যান্ড করবো করবো করছি। প্রশান্ত মহাসাগর ছাড়িয়ে বিশালাকার প্লেনখানা কয়েকটা চক্কর দিয়ে নীচে নামা শুরু করলো। সন্ধ্যে বাতির আলো ঝলমলে আভায় ঘরবাড়ি পরিস্কার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী বদলে গেলেও বদলায়নি সূর্যোদয়ের দেশটি। একটুও বদলায়নি এর অবয়ব। করোনা পাল্টে দিয়েছে পৃথিবী; পাল্টাতে পারেনি বহুদিন ধরে বাস করা আমার দ্বিতীয় বসতভূমি! চলবে...

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com