স্বেচ্ছাসেবার অনুভূতি সীমাহীন আনন্দের
প্রকাশের সময় : 2021-11-17 15:46:28 | প্রকাশক : Administration

আবু সালেহ মুসা: কিছুদিন আগে একটি রিপোর্টের কাজে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। গেট দিয়ে ঢোকার পর দূর থেকে ইমার্জেন্সি রুমের পাশে লাল কটি পরা কিছু ছেলে-মেয়েকে দেখলাম। হাসপাতালে এর আগে এমন পোশাকে আর কাউকে দেখিনি। কাছে গিয়ে দেখি এরা রেড ক্রিসেন্টের সদস্য। তবে এখানে কি? ভাবলাম তারা হয়তো কোনো কাজে এসেছিলো।
এমন সময় হঠাৎ এক ভদ্রলোক দৌঁড়ে এসে একজন সদস্যকে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। আর বললেন, ‘তোরে না কইছিলাম আমার কার্ডটা আগে দিবি। তোর এত বড় সাহস আমারটা না দিয়ে অন্যগুলা দিছোস? বেয়াদব, বড়দের কিভাবে সম্মান করতে হয় তাও শিখো নাই?’ ছেলেটি কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আপনার সিরিয়ালতো অনেক পরে। আমরা সিরিয়াল ছাড়া আপনাকে আগে কীভাবে দিবো?’
এতে ওই লোক আরও ক্ষিপ্ত হয় ও নানা হুমকি দিয়ে বের হয়ে যায়। ঘটনাটি জানতে এক প্রকার আড়ি পেতেই দাঁড়ালাম সেখানে। বিষয়টি আমার কাছে একটু অন্যরকম লাগলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তবে তারা বলতে চায় না। তখন আমি একজন সংবাদকর্মী পরিচয়ে তাদের আশ্বস্ত করলাম। তখন একজন বললেন, ‘তারা হাসপাতালে করোনার টিকা দেওয়ার বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিদিন অনেক ভিড় হয়।’
‘তাই শৃঙ্খলা রক্ষায় সবাইকে একটি সিরিয়ালের মাধ্যমে টিকার জন্য ভেতরে পাঠানো হয়। তবে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ক্ষমতাবান লোক আসেন ও তারা সিরিয়াল না মেনে আগে ঢুকে যান। এতে বাঁধা দিলে আমরা নির্যাতনের শিকার হই।’ তিনি আরও জানান, ‘গতকালও একটি ছেলের মাথায় ঘুষি মেরে ফাটিয়ে ফেলে। এরকম প্রতিদিনই কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছি।
যদিও আইনি সহায়তা নিয়েছি, তবে তাতে খুব বেশি ফল হচ্ছে না। পুলিশ যতটুকু পারছে নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবে আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ঠ নয়।’ সব শুনে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের বেতন কত?’ এই প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে রাখলেন ওই স্বেচ্ছাসেবী। আবারও জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, ‘কোনো বেতন নেই।’ দুপুরে খাবার আর ভাড়া বাবদ কত টাকা পান? ‘এক টাকাও না।’ নাস্তা তো পান? ‘না’। এবার অবাক না হয়ে পারলাম না।
আবারও প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে করেন কেন এ কাজ? আবারও নিশ্চুপ তিনি। কোনো উত্তর দিলেন না। আমিও নাছোড়বান্দা, তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন, ‘আত্মতৃপ্তির জন্য। কাউকে সাহায্য করার অনুভূতি হাজার টাকার চেয়েও বেশি।’ এসব শুনে আর কিছুই বলার সুযোগ পেলাম না। কেমন সেই অনুভূতি, কেমন সেই আত্মতৃপ্তি! যাই হোক উত্তরটা নিশ্চয়ই পেয়েছেন।
আসলে রেডক্রিসেন্ট সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে সর্বদাই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এর সদস্যরা অত্যন্ত গতিশীলভাবে বিনা পারিশ্রমিকে সব ভালো কাজে দিন থেকে রাত পর্যন্ত নিরলসভাবে ব্যস্ত থাকেন। তারা দেশ ও জনকল্যাণমুখী কাজে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রায় সব কাজের মাধ্যমেই তারা আলোচনার তুঙ্গে আছেন।
সেদিন অকারণে কলেজে যাইনি। বাড়িতে সারাদিন বিশ্রাম করবো বলে ভেবেছিলাম। সকালে অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠবো এমনই চিন্তা ছিল। তবে হঠাৎই ফোন বেজে উঠলো। খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলাম। রিসিভ করতেই ওপার থেকে বলে উঠলো, তুমি কই? কেন ভাই কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করলাম। বললো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে। কেন? জরুরি কাজ আছে।
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও খুব তাড়াতাড়ি রওয়ানা হয়ে হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি একজন নারীকে ঘিরে বেশ কয়েকজন রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? একজন জানালেন, সকালে একজন ফোন দিয়ে জানান, হাসপাতালে একজন অপরিচিত নারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পড়ে আছেন। তার সঙ্গে কেউই নেই। ব্যথায় কাঁতরাচ্ছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন এখনই তার সিজার করাতে হবে।
তবে দলনেতা আবু তাহের ভাই গোমড়ামুখে জানালেন, ‘সিজার করাতে টাকা লাগবে যা এই মহিলার কাছে নেই।’ তবে আমরা সবাই জানালাম, যেভাবেই পারি এই মাকে আমরা বাঁচাবোই। এরপর ওই মাকে হাসপাতাল থেকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। তার দ্রুত সিজার করা প্রয়োজন। তাকে হাসপাতালে রেখে আমরা আর দেরি না করে সবাই মিলে টাকা সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়লাম। দোকানে, গাড়িতে, বাড়িতে হাত পাতলাম।
টানা এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ১৫ হাজারের মতো টাকা তুলতে সক্ষম হলাম। এরই মধ্যে ওই ক্লিনিকের মালিক অপারেশন বাবদ মোটামুটি বড় অংকের টাকা দিয়ে সহায়তা করলেন। সব মিলিয়ে সিজারের বিল মেটানো সম্ভব হলো। এরপর তাকে ওটিতে ঢুকানো হলো। বাইরে আমরা সবাই অপেক্ষারত। এরই মধ্যে ওটি থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে আসলো।
কিছুক্ষণ পর নবজাতককে নিয়ে একজন নার্স ওটি থেকে বের হলেন। আমরা সবাই দেখলাম, একটি ফুটফুটে শিশু ভূমিষ্ট হয়েছে। সবাই মিলে অনেক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য করে নার্স বললেন,‘আপনাদের কষ্ট স্বার্থক হয়েছে। মা ও সন্তান দু’জনেই ভালো আছেন। আপনারাই সত্যিকারের মানুষ। যদি কখনও সুযোগ হয় তাহলে এরকম ভালো কাজগুলোতে আমাকেও ডাকবেন।’
নার্সের অনুমতি পেয়ে আমরা এবার ওই মায়ের সঙ্গে দেখা করি। আমাদের দেখে তিনি কাঁদেন। আমরাও তাকে প্রাণ ভরে কাঁদতে দিয়েছিলাম। তার এমন বিপদে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন কেউই পাশে দাঁড়ায়নি। নেয়নি কোনো খোঁজও। তবে হঠাৎ করেই কিছু ছেলেমেয়ে এসে তার বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাড়িয়ে দিয়েছে ভরসার হাত, তা তিনি নিজেই জানেন না। এই উপকার কি সে ভুলতে পারবে?
এরপর আমরা তার কিছু ঔষধের ব্যবস্থা করে সেখান থেকে চলে আসি। যাই হোক, এখন আমি সম্পূর্ণভাবে বুঝে গিয়েছি কেমন সেই আত্মতৃপ্তি আর কেমন সেই অনুভূতি। আমি এখন শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট এরকম অনেকেরই ভরসার হাত। তারা কারও ক্ষতি করে না বরং ক্ষতির শিকার হয়। তবুও সব ভালো কাজে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি গর্বিত, কারণ আমি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের একজন গর্বিত যোদ্ধা। - সূত্র: অনলাইন