ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ
প্রকাশের সময় : 2022-06-08 16:34:15 | প্রকাশক : Administration

আরিফুজ্জামান তুহিন: ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের মানুষ বিশেষত দরিদ্র মানুষের জন্য ভয়াবহ এক লোক। তার উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ গরিব মানুষের জন্য শুধু অভিশাপই নয়, গোটা গ্রাম ছারখার করে দিয়েছে। আমার একটা ছোট গবেষণা ছিল। সেখানে যা বেরিয়ে এসেছিল সেটা ভয়াবহ। সেখানে পাওয়া গেছে, কিস্তি নেবার ফলে সে একটা দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছে। সেই চক্র ভেদ করতে গিয়ে, আবারও অন্য এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। এভাবে একের পর এক এনজিওর ঋণে সে আবদ্ধ হয়েছে। যারা এই ঋণ শোধ করতে পারেননি তাদের কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। ঋণ নেওয়া হয়েছে নারীর নামে। ফলে কিস্তির সময় পুরুষটি ভয়ে বাড়ি থাকে না। সামলাতে হয় নারীকে। অনেক পুরুষরা আমাদের অভিযোগ করেছেন, তার স্ত্রী আর তার নেই। এতে ঘরে ঘরে অশান্তি হয়েছে, নানান ধরনের সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস হয়েছে।
সব থেকে বড় সংকট হয়েছে, মানুষের প্রোটিনে ঘাটতি পড়েছে। কারণ বাড়িতে যে ডিম হতো, গাছে যে লাউ ও অন্যান্য সবজি হতো সেসব বিক্রি করে কিস্তির টাকা শোধ করেছে। এর ফলে পরিবারের সদস্যরা প্রোটিন কম নিয়েছে। এর ফলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবারের নারী সদস্যরা। কারণ খাবার কম হলে নারীরাই তার প্রথম ভিক্টিম হন। দেখবেন, যে পরিবারে অভাব আছে সেখান মা কম খান, নিজে ডিম না খেয়ে ছেলেকে দেন বা স্বামীকে দেন। ফলে ইউনূসের মডেল নারীর ক্ষমতায়নের বদলে বরং ওইসব ঋণ নেওয়া নারীর স্বাস্থ্য ভেঙে দিয়েছে। এটা নিয়ে আরও নিবিড় গবেষণা হওয়া দরকার ছিল।
আর দারিদ্র বিমোচন একটা পুরান কথা। বিশেষত এনজিও মডেলে। দেশের সব থেকে দরিদ্র পিড়িত জেলা কুড়িগ্রাম। যেখানে অর্ধেক মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন। কুড়িগ্রাম থেকে দুনিয়ার সব থেকে বড় এনজিও ব্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কুড়িগ্রামের মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারেনি ব্র্যাক, কিন্তু ব্র্যাকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। ফজলে হাসান আবেদ থেকে ফজলে হাসান আবেদ স্যার হয়েছেন। দেশী এনজিও আন্তর্জাতিক জায়ান্ট এনজিও হয়েছে। কিন্তু কুড়িগ্রামের মানুষের ভাগ্য বদল করতে পারেনি গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ এনজিও। আরেকটি তথ্য নিন, কুড়িগ্রামের প্রতি ১ কিলোমিটারের মধ্যে একটি এনজিও আছে। বাংলাদেশে যত প্রকার, যতো ধরনের এনজিও আছে সবগুলোই কুড়িগ্রামে আছে। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, যেখানে যতো এনজিও সেখানে ততো দরিদ্র মানুষ। এনজিওগুলো মূলত দরিদ্র কালচার করে, তারা এটা জিইয়ে রাখে। মহাজনরা যেমনটা করতেন।
ওয়ান ইলেভেন হয়েছে, মানে ২০০৭ সালে একটা সামরিক ক্যু হয়েছে। সেই ক্যু’র সরকারের সামনে এনজিওদের প্রতিনিধিরা থাকলেও পেছনে ছিল সামরিকতন্ত্র ও আমলারা। সেই সরকার ঘরের মধ্যেও আলাপ আলোচনা নিষিদ্ধ করে দেয়, সেটার সুশীল নাম ছিল ঘরোয়া রাজনীতি নিষিদ্ধ। অথচ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস একটা দল খুলতে চাইলেন সেটার কার্যক্রম চালানোর জন্য তিনি হটলাইন খুললেন। অফিস নিলেন। সেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মিলিটারি ব্যাক সরকার নিষিদ্ধ করল না। সে সময় আবার চট্টগ্রাম বন্দর আমেরিকাকে দেবার কথা হচ্ছিল। ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস সেই দিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিল এমনটাই বোঝা যাচ্ছিল। আমরা বুঝতে পারতেছিলাম, একটা মহাসর্বনাশ ঘটতে যাচ্ছে। কারণ ততক্ষণে ওয়ার অন টেরর প্রকল্পে দুনিয়া যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মার্কিন সৈন্যরা আসলে কি হবে আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র। আমাদের অনার্সের সমাবর্তনের তারিখ ঘোষণা হয়। সমাবর্তনে আসবেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। আমরা অল্পকিছু মানুষ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের আসার বিরোধিতা করি। তখন জরুরি অবস্থা চলায় মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে আমরা ক্রিয়াশীল ডানপন্থি ও বামপন্থি সকল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। কেউ সেদিন ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের আসার বিরোধিতা করে সরাসরি মাঠে নামার সাহস দেখায়নি।
সেদিন ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের বিরোধিতা করে প্রথম স্লোগান কলাভবনের ভেতর থেকে শুরু হয়। মিডিয়া আমাদের ছেকে ধরেছিল। আমরা খুব পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলাম, সব দলের রাজনীতি বন্ধ রেখে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের দল করার রাজনীতি চালু রাখাটার মধ্য দিয়ে এই সরকারের ইচ্ছেটা প্রকাশ করেছে। ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণে গোটা দেশের মানুষের সর্বনাশ ঘটেছে। এরকম একজন বিতর্কিত লোকের হাত থেকে আমাদের সনদ আমরা নেব না। তাকে বয়কট করা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো জায়গা নেই। সেরকম সময় এই বক্তব্য দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও সাহসের ব্যাপার ছিল। আমাদের মিছিল যখন কলভাবনের মেইন গেটের সামনে আসে তখন গুনে গুনে ২৮ জন ছিলাম আমরা। সেই মিছিলকে গোটা ক্যাম্পাসের লোকেরা আতঙ্ক নিয়ে দেখছে। এমনকি সেদিন সাদা পোষাকে অসংখ্য পুলিশ ছিল, তারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কারণ এর কয়েকদিন আগে থেকে আমরা লিফলেট বিলি করছিলাম ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে বয়কট করে ও মিছিল সমাবেশের কর্মসূচির কথা বলছিলাম। সে কারণে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ ছিল।
আমার মনে আছে, গোটা কলাভবন প্রদক্ষিণ করে লাইব্রেরির সামনে যখন সমাবেশ শেষ হলো, তখন অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের চোখে রীতিমতো শর্ষের ফুল। কারণ জরুরি অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করছে, ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের বিরোধিতা করা হচ্ছে এটা রিতিমত বিস্ময়ের ও সাহসের ছিল। সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল একটা বিষয়। একজন বামপন্থী ছাত্রনেতা সেদিন মধুর কেন্টিন থেকে একটু সামনে ডাকসু সংগ্রহসালার সামনে দাঁড়িয়ে ডিবি পুলিশের সাথে কথা বলছিলেন। ডিবি পুলিশ আমাদের প্রত্যেকের ছবি ও ভিডিও করেছিলেন। সেই ছবি দেখিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। কে কোন হলে থাকে তা বর্ণনা করছিলেন।
মধুর কেন্টিনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। সেদিন মধুর কেন্টিনের ছেলেগুলো আমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন। তাদের লুঙ্গি, কালিঝুলি মাখানো ফতুয়া পরতে দিয়েছিল। আর দিয়েছিল বাজার করার টুকরি। সেদিন মিথুন (মিথুন ছাত্র ইউনয়ন করত। এখন মনে হয় বিজনেস স্টান্ডার্ডের সাংবাদিক) আমাদের মুখে তেল ও কালিঝুলি মাখিয়ে মেকাপ করে দিয়েছিল। আমি যখন আমার বান্ধবীর সামনে দিয়ে মাথায় টুকরি নিয়ে হেঁটে গেলাম, তিনিও আমাকে চিনতে পারেননি। সেই ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় হয়রানির কথা মনে থাকবে চিরদিন।
ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয় আমার ফয়সালা বহু আগেই শেষ হয়েছে। নতুন করে সেখানে যোগ হয়েছে, একটা দেশের বিরুদ্ধে আমেরিকার কাছে নালিশ করার মতো জঘন্য বিষয়। ফলে অন্যান্য মানুষের মতো ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ে আমার কোনো আদিখ্যেতা নেই। আমি গ্রাম থেকে ওঠে আসা মানুষ। আমি গ্রামের মানুষের সংকট বুঝতে চাই, বোঝার চেষ্টা করি। আমি শহুরে মানুষের চোখ দিয়ে গ্রাম দেখি না। - লেখক: সাংবাদিক