তুরস্কঃ সুলতান সুলেমানের দেশ
প্রকাশের সময় : 2022-07-18 17:33:00 | প্রকাশক : Administration

জেসিউর রহমান শামীম: তুরস্ক বিশ্ব মুসলিমের কাছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ। প্রায় ৯৫ ভাগ এশিয়াতে ও মাত্র ৫ ভাগ ইউরোপে অবস্থিত এই দেশটি। যা একসময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে দেশটি খুবই সমৃদ্ধ। দেখে মনে হয় যেন সৃষ্টিকর্তা অতি নিপুন যতেœ তৈরি করেছেন তুরস্ককে। দেশটির সরকারি নাম রিপাবলিক অফ তুর্কি। তুরস্কের মানচিত্র অনেকটা চতুর্ভূজের মতো। এটি ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় অবস্থিত। এর পশ্চিমে এজিয়ো সাগর ও গ্রিস, উত্তর-পূর্বে জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া। পূর্বে ইরান। দক্ষিণে ইরাক, সিরিয়া ও ভূমধ্য সাগর।
আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ৩৬ তম দেশ তুরস্কের মোট আয়তন প্রায় ৭ লক্ষ ৭৩ হাজার ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার এবং দেশটির মোট জনসংখ্যা ৮ কোটি ৩৬ লাখের কিছু বেশি। বিশাল এই জনসংখ্যার অর্ধেকই হচ্ছে তার্কি বা তার্ক। এর পরেই আছে কুর্দি জনগণ যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। এছাড়াও আরও প্রায় ১০ টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে আসছে দেশটিতে। এখানকার প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তারপরেও এটি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। বাকি অংশের মধ্যে কিছু আছে যারা কোনো ধর্মই পালন করে না। এর পাশাপাশি খ্রিষ্ঠান, ইহুদির মত অন্যান্য ধর্মের মানুষও আছে। বলা হয়ে থাকে ইস্রায়েল এর পরে সবচেয়ে বেশি ইহুদি এ দেশেই বাস করে।
তুরস্কের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল। বহু আগে থেকেই বিচিত্র জাতি গোষ্ঠীর আগমন ঘটে এই দেশটিতে। ফিজিও, গ্রীক, রোমান, পার্সিক এবং আরবরা বসবাস শুরু করে। মধ্য এশিয়ার যাযাবর তুর্কি জাতির লোকেরা ১১ শতকে দেশটি দখল করে এবং এখানে সেলজুক রাজ বংশের পত্তন করে। তখন থেকেই এই এলাকার লোকেরা তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়। মংগোলদের আক্রমণে সেলজুক রাজ বংশের পতন হয়। তারপর শুরু হয় ওসমানীয় রাজত্বের শাসন। যা প্রায় ৬০০ বছর চলতে থাকে।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা হলেও এর বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুল। এ দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ তুর্কি ভাষাতে কথা বলে। এছাড়াও আরও ৩০ টি ভাষা এখানে প্রচলিত আছে। তুরস্কের মানুষ চা খেতে খুব পছন্দ করে। দেশটিতে কারো কাছ থেকে চা এর দাওয়াত পেলে না করার নিয়ম নেই। সারা পৃথিবীতে তুর্কিরাই বেশি চা পান করে। কম বেশি প্রায় একশত রকমের চা পাওয়া যায় এখানে। চা কে এ দেশে ‘চায়ে’ নামে ডাকা হয়। তুরস্কের একটি রীতি হল খাবার খাওয়া শেষে ফল পরিবেশন করা।
তুরস্কে প্রায় ১১ হাজার বছর আগে কৃষিকাজ এর সূচনা হয়েছিল। সুপরিকল্পিত কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করে। কৃষিতে শস্য ছাড়াও ফুল চাষে বেশ এগিয়ে। টিউলিপ এর কথা মনে করলে সবার আগে তুরস্কের নাম মনে আসে। সার বিশ্বে টিউলিপ এর প্রচার এখান থেকেই হয়। এমন প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির ফুল আছে যা তুরস্ক ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার প্রজাতির পাখি পাওয়া গেছে যার মধ্যে ৪৫৩ প্রজাতির পাখি শুধুমাত্র ইস্তাম্বুলে পাওয়া যায়। শুরু থেকে আজ অবদি ব্যবসা বাণিজ্যে জমজমাট ইস্তাম্বুল শহর। এখানে রয়েছে গ্রান্ড বাজার। ১৪৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বাজারে ছোট বড় ৬৪ টি রাস্তা এবং ৪ হাজার দোকান রয়েছে। একমাত্র এই শহরটি এশিয়া ও ইউরোপ এই দুই মহাদেশ মিলে গড়ে উঠেছে।
তুরস্কে বেশ কিছু সিগনেচার ট্যুরিস্ট স্পট আছে এর মধ্যে হাজিয়া সোফিয়া তুরস্কের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটক আকর্ষণীয় স্থান এবং বিশ্বের প্রাচীনতম ভবনগুলোর একটি। ষষ্ঠ শতকে বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান এই ভবনটি মূলত অর্থডক্স গীর্জা হিসেবে নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীকালে মসজিদে রুপান্তর করা হয়। এর অসাধারণ স্থাপত্য এবং বাইজেন্টাইন ও মুসলিম অলংকরণের সাজসজ্জা দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।
হাজিয়া সোফিয়া এর কাছেই তুরস্কের আরেকটি মন ভুলানো স্থাপত্য- ব্লু− মস্ক। ইস্তাম্বুল শহরের চমৎকার স্থাপত্যশৈলী ও ৬টি মিনারের সুলতান আহমেদ মসজিদ বা নীল মসজিদটি বাইরে থেকেই মুগ্ধতার সৃষ্টি করে। এটি তুরস্কের আরেকটি পর্যটক আকর্ষণের স্থান। এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয় ১৬০৯-১৬১৬ শতকে। মসজিদের ভেতরের উঁচু সিলিক্সে ২০,০০০ বিভিন্ন ধরনের নীল টাইলস লাগানো আছে যার কারণে মসজিদটির নাম নীল মসজিদ হয়েছে।
তুরস্কের জনপ্রিয় স্থানগুলোর একটি ইফেসাস যা সেলকাকের নিকট অবস্থিত। বিশ্বের সেরা গ্রীক ও রোমান ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ এখানে সংরক্ষিত আছে। প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি এই ইফেসাস শহরটি যা একসময় আর্টেমিসের মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। মন্দিরটি অসাধারণ স্থাপত্য শিল্পের জন্য সবার সুনাম কেড়ে নেয়।
মোসেন সময়কালে ভলকানোর অগ্ন্যোৎপাতে জন্ম নেওয়া প্রাকৃতিক শিলা এবং অনন্য ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত হলো কাপাদ্দোসিয়া। এই ভূগর্ভস্থ শহরটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে বেশ আগেই। এখানকার সবচেয়ে বড় পর্যটক আকর্ষণ হলো বেলুন ট্যুর। ভূপৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট ওপরে এক-দেড় ঘন্টার জন্য ভেসে বেড়াতে এবং মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে এখানে অনেকেই আসেন। এছাড়াও তুরস্কের আরো কিছু আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে নমরুদের পাহাড়, ট্রয়, বোদ্রাম ক্যাসেল, পামুকালে, পাতারা বীচ, এস্পেন্ডোস থিয়েটার, অলোডেনিজ, বেসিলিকা সিস্টারন ইত্যাদি।