প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি ষড়যন্ত্রের মুখে?
প্রকাশের সময় : 2022-09-15 12:17:42 | প্রকাশক : Administration

মহসীন হাবিব: রাজনৈতিকভাবে কেমন আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? চারদিকের বডি ল্যাঙুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর নানা ধরণের চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সে কথা খুশির সঙ্গে বিএনপি নেতারাও উচ্চারণ করেছেন। তৈরি করতে চেষ্টা করা হচ্ছে একটি সরকার বিরোধী নতুন প্লাটফর্ম। সেই প্লাটফর্মে যোগ দিয়েছে প্রাক্তন আওয়ামী লীগার, পুরোনো জাসদ, লুক্কায়িত জামাত ও যথারীতি বিএনপির কিছু নেতা। শেখ হাসিনা নিজেও ২১ আগস্ট বললেন, ‘আঘাত আরো আসবে, দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে।’
চক্রান্তই বলি, ষড়যন্ত্রই বলি কিছু একটা যে চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এমনটাই ঘটে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার মাত্রা কী, কতটা বাইটিং পাওয়ার আছে সেই ষড়যন্ত্রকারিদের? শক্তিশালি দেশগুলিকে, বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে তারা কতটা করায়ত্ত করতে পেরেছে; যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কতটা কাজ করবে আজকের দিনের বাংলাদেশের রাজনীতিতে, কতটাই বা হাত বাড়াতে চেষ্টা করবে দেশটি এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ধান ভানতে একটু শিবের গীত গাওয়া প্রয়োজন। তা না হলে বোঝা যাবে না, বাস্তব চিত্রটি কতটা ভারী বা কতটা তুচ্ছ।
সম্প্রতি এক বছর পূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর মেয়াদের শেষ বছর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি করেন। কার সঙ্গে এই চুক্তি করেন? না, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পছন্দের আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারের সঙ্গে নয়। চুক্তি করেছেন সেই তালিবানদের সঙ্গে, যাদের বিরুদ্ধে ২০ বছর আগে যুদ্ধে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অসংখ্য তালিবান নিহত হয় সেই যুদ্ধে। তালিবান নেতা মোল্লা ওমর ২০১৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়িয়েছেন।
দোহায় অনুষ্ঠিত ওই চুক্তি অনুসারে আফগানিস্তানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। চুক্তিতে একথাও উল্লেখ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। এরপর পরই আমেরিকায় ক্ষমতার পরিবর্তন হলো। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম কোলাহলপূর্ণ নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় প্রেসিডেন্ট হলেন ডেমোক্র্যাট দলের জো বাইডেন।
তিনি এসে ২০২১ সালের মার্চ মাসেই ঘোষণা দিলেন, সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। কিন্তু তালিবানদের চাপে সেই তারিখ এগিয়ে ৩১ আগস্ট করা হয়। একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে যে ফাটল, যে বৈরিতা দেখা দিয়েছে তা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে হার মানিয়েছে। জাতীয় প্রতিটি বিষয়ে একদল ‘ইয়েস’ বললে অন্য দল ‘নো’ বলে দিচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলির ব্যাপারে পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বরাবর।
যাহোক, সৈন্য প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট সর্বশেষ সেনা প্রত্যাহার করা হয়। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয় কাবুল বিমান বন্দরে। বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তানকে ‘শাসন’ করতে যে বিশাল কমিউনিটি গড়ে তোলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে, তাদের মাত্র গুটিকয়েক সৌভাগ্যবানকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে তারা আফগানিস্তান ছাড়ল।
সারা পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখল জংলি সদৃশ তালিবানদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বোয়িং প্লেনের ডানায়, চাকায় ঝুলে মানুষ আফগানিস্তান ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টায় আকাশ থেকে টপটপ করে পড়ছে। এ নিয়ে ইউরোপের তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো মিনমিন করে কী যেন বলল আমরা ভালো করে শুনতেও পেলাম না!
পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ যখন চায়নি যুক্তরাষ্ট্র গোটা আফগানিস্তান দখল করুক, তখন তারা দখল করেছিল। আর গোটা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ যখন চাইল রাতারাতি দেশটি এরকম অরক্ষিত রেখে তারা সরে না যাক, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা রাতারাতিই গেল কোনো লিগ্যাল সরকারের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে। আফগানিস্তানে প্রবেশের সময় তারা যেমন সাধারণ আফগানদের মত নেয়নি, তেমনি ছেড়ে আসার সময়েও সাধারণ মানুষের মতের তোয়াক্কা করলো না।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই প্রশ্ন করি, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন আপনারা, যেই হামিদ কারজাইকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেশ চালিয়েছেন, তিনি আফগান জনগণের সুষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত? বলতে পারবেন, যে আশরাফ ঘানিকে দিয়ে দীর্ঘদিন দেশটি চালিয়েছেন তিনি আফগানদের সুষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত?
আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া নিয়ে সারা পৃথিবীর মানবাধিকার কর্মীরা, শান্তিপ্রিয় সংগঠনগুলো যখন উদ্বেগ প্রকাশ করলো তখন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বললেন, আমেরিকার মিলিটারির দ্বারা আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক, স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব না। অতএব ব্রিটিশ, ফরাসি প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ইংরেজি, ফরাসি শেখা হাজার হাজার আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স সদস্য, অনুবাদক, বিভিন্ন এনজিওর হয়ে কাজ করা মানুষদের থেকে মুখ ফিরিয়ে এভাবে চলে গেলেন?
আরো বৈপরিত্য লক্ষ করুন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে আফগানিস্তানের সেন্ট্রাল ব্যাংকের ৯ বিলিয়ন ডলার ফ্রিজ করে রাখা আছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড় করাতে চেয়েছিলেন ৯/১১ এর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য। সম্প্রতি সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড় করাতে চেয়েছিল এই শর্তে যে তালিবানরা এই অর্থ সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার করবে না। কিন্তু আল-কায়দা নেতা আয়মান আল জাওয়াহারিকে কাবুলে হত্যার পর এই অর্থও আটকে দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে তালিবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে নানা কারণে আবার বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আল-কায়দাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, যদি তালিবানদের হাতে আফগানিস্তানের অর্থ দেয়ার ভরসা না-ই পান, তাহলে গোটা দেশ, মহামূল্যবান নারী-পুরুষ-শিশুর প্রাণ তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন কী করে? যেদিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে, সেইদিন থেকে নারীদের উপর, আধুনিক মানুষদের উপর খড়গ নেমে এসেছে। আপনারা বুঝি এমন হবে জানতেন না? এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে ৭০ লক্ষ মানুষ সরাসরি ক্ষুধার্ত। লক্ষ লক্ষ আফগান শিশু স্কুল থেকে উধাও হয়ে গেছে। চাকরিজীবী নারীদের কর্মস্থল থেকে বিতাড়িত করছে তালিবানরা। ‘এইডা কুন বিচার?’
নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র অনেক শক্তিশালী দেশ। তাদের সঙ্গে আছে অন্ধ সমর্থক যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও স্ক্যানডিনেভিয়ার দেশগুলি। এসব দেশের মধ্যে কোনোটি বাধ্য হয়ে, আবার কোনোটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, টিআইবি, ন্যাটো, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গনাইজেশন, আইএলও, আইএইএ, আইসিসি, রেডক্রস, আইসিএও, ডব্লিউটিও, ইকোনোমিক ফোরামসহ আরো অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংগঠন এবং বিশাল মিডিয়া। সেই সঙ্গে আছে তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশারী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপাবিলিটিকে খাটো করে দেখার অবকাশ নাই। অধিকন্তু তার একটি বড় টুলসের নাম ‘গণতন্ত্র’। এটি তৃতীয় বিশ্বে প্রয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে কতবড় কার্যকরি একটি ধারালো অস্ত্র এবং ধন্বন্তরি মেডিসিন তা বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্রের এই দাওয়াই বিগত দিনে বিশেষ ফল দিয়েছে। যে সরকার বা শাসক কথা শোনে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ মেটায় সেই শাসক গণতান্ত্রিক এবং তার কোনো সমস্যা নাই! কিন্তু যে দেশ কথা শুনবে না, তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ধোয়া তুলতে দেখা যায় ‘গণতন্ত্র নাই, নির্বাচন সুষ্ঠ হয় নাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে’ ইত্যাদি করে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে!
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জার নিজেই বলেছেন,‘আমেরিকার স্থায়ী কোনো বন্ধু বা শত্রু নেই; আমেরিকার নিজের ইন্টারেস্টটাই বড় কথা।’ সত্য স্বীকার করার জন্য তাকে ধন্যবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের বৈপরিত্যপূর্ণ আচরণের আমি অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি। তাতে পাঠক ধৈর্যই হারাবেন হয়তো।
আফ্রিকায় ইক্যুইটারিয়াল গিনি নামে ছোট্ট একটি দেশ আছে। সেই দেশ দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে শাসন করছেন অশিতিপর বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট তিওদোরো অবিয়াঙ গিইমা বাসাগো। ছোট্ট দেশ পুরোটাই তেলের উপর ভাসছে । আফ্রিকার তৃতীয় বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী এই দেশের জিডিপি পার ক্যাপিটা ৫০ হাজার ডলারের বেশি। ইউরোপের ধনীতম দেশ লুক্সেমবার্গের পরেই। কিন্তু গোটা দেশের মানুষ অনাহার অর্ধাহারে থাকে। সিংহভাগ অর্থ চলে যায় আমেরিকার রিগস ব্যাংকে বাসাগের নামে।
একেকটি তেল ও গ্যাস ফিল্ডের বড় শেয়ারার আমেরিকার শেভরন কোম্পানি। প্রেসিডেন্ট দেশের মানুষকে বিশ্বাস করেন না। তাকে পাহাড়া দেয় ভাড়া করা মিশরীয় দুর্ধর্ষ মারসেনারি। প্রতি ৫ বছর পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়, এবং রেডিও, টিভিতে বলে দেওয়া হয় বাসোগো পেয়েছেন ৯৭ শতাংশ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৩ শতাংশ ভোট। সেই প্রতিদ্বন্দ্বীও আবার ঠিক করে দেন প্রেসিডেন্ট বাসোগো।
এতে গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতি হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্টলেডিদের বাসাগোর সঙ্গে গলাগলি করা হাসিমুখের ছবি ছাপা হয়। ক্ষমতার প্রথম দিকে যখন ‘দুধ দোয়ানোর’ অবস্থা হয়নি, তখন বাসোগো ছিলেন ডিক্টেটর। এখন তিনি ডিক্টেটর না! ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়াল্টার এইচ, ক্যাানস্টাইনার আইএএসপিএস ফোরামে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আফ্রিকার তেল হলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট। তাকেও সত্য বলার জন্য ধন্যবাদ।
উন্নয়নশীল দেশগুলি যখন খবরদারি শোনে না, তখন সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখতে পায়, গণতন্ত্রের ত্রুটি এবং অভাব দেখতে পায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তার হুক্কাহুয়া দেশ ও সংগঠনগুলি। দৌড়ে আসে গণতন্ত্র উদ্ধার করতে। বিরোধী দলের বিরোধীতাকে মদদ দিতে থাকে। অশিক্ষিত দেশগুলির বিরোধী দলেরও একমাত্র ধ্যান জ্ঞান থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। এর যেন কোনো ব্যত্যয় নেই!
যুক্তরাষ্ট্রের বডি ল্যাঙুয়েজ থেকেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কারণে তারা শেখ হাসিনার উপর এখন আর সন্তোষ্ট নয়। অথবা স্বার্থ হাসিল হচ্ছে না। সেটা হওয়ার কয়েকটি জোরালো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা পিতার মতই স্বাধীনচেতা। বিদেশিদের সব কথা না শোনার ভীষণ প্রবণতা আছে। এটি সাধারণত সুপার পাওয়ারের পছন্দ না। দ্বিতীয়ত, ভুরাজনৈতিক মেরুকরণের কারনে বাংলাদেশ, বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বাজার হিসাবে আগের চেয়ে এখন অনেক বড় হয়েছে। সুতরাং সরকারকে চাপে ফেলা এখন বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই এলিট ফোর্স তৈরি করার জন্য কী দৌঁড়-ঝাপই না করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে মনে আছে? ২০০৪ সাল থেকে র্যাবের ক্রস ফায়ারে অনেক লোক মারা গিয়াছে সত্য। কিন্তু এখন যখন র্যাবের হাতে মৃত্যু প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে তখনই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো! এর মানে কী?
র্যাব বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবতা সেটা যুক্তরাষ্ট্রেরই সবচেয়ে ভালো বোঝার কথা ছিল। কারণ গত শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন নাজুক হয়ে পড়েছিল তখন এফবিআইর প্রতিষ্ঠাতা এডগার হুবারের আবির্ভাব ঘটে। অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিল তারা। হবারের কথা যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান বলেছিলেন, ‘এফবিআই হুভারের ব্যক্তিগত গোপন বাহিনীতে পরিণত হয়েছে...আমরা আরেকটি গেস্টাপো বাহিনী চাই না।’
সেই হুভার কিন্তু এখনো দেশটির হিরো হিসাবে পরিচিত। হুভারের নামে ভবনের নাম, হুবারের নামে হুভার ইন্সস্টিটিউট রয়েছে। যত দোষ এই নন্দ ঘোষদের, নাকি? একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রের, ইউরোপের কূটনীতিক আসছেন বাংলাদেশ সফরে আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ২০২২ সালের হিসাব নিয়ে দেখুন, সভ্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রে কয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে আর দরিদ্র বাংলাদেশে কয়টা ঘটেছে! অথচ তারাই আমাদের ‘উদ্ধার’ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
হ্যা, অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে দুর্নীতি কমানো যায়নি। কিন্তু সে দুর্নীতিবাজ কে? তার কি নিজস্ব কোনো দল আছে? মুখে ড. লুৎফর রহমান বা ডেল কার্নেগীর মত নীতি আদর্শের কথা বললেও এদেশে দুর্নীতির সঙ্গে যোগসূত্র নাই এমন মানুষ বাতি লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া কঠিন। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। যারা ২১ আগস্ট বোমা হামলার, হাওয়া ভবন বাণিজ্যের, অর্থ পাচারের বিশাল আয়োজনের কথা ভুলে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে এখন মরিয়া, তাদের কাছে গ্যারান্টি আছে যে বিএনপি-জামাত ভালো হয়ে গেছে। অথবা বাংলাদেশে আবার জঙ্গীবাদ মাথা চারা দেবে না, দুর্নীতি হবে না বা দলীয়করণ চলবে না।
অথচ তারা আবার সরকারের বিরুদ্ধে নেমেছে। ১৯৭৫ সালের মত সরকারের বিরুদ্ধে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে নানা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ গল্প ফাঁদছে। সুতরাং সরকারকে সাবধান হতে হবে। বিরোধীতাকারীদের খাটো করে দেখলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীরা এখনো সংগঠিত। তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের কিছু শক্তির সম্পর্ক নিবিড়। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, তত চাপ বাড়তে থাকবে। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে যে নির্বাচনের বাইরে গিয়ে তারা বিকল্প পথ খুঁজছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। এসব গুজব ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কখনো কখনো গুজবের দিকেও কান সজাগ রাখতে হয়। - ইত্তেফাক/এএইচপি
