বৃটিশ ভারতের একটা কালো দিন

প্রকাশের সময় : 2022-10-26 15:54:41 | প্রকাশক : Administration
বৃটিশ ভারতের একটা কালো দিন

গাজী মিজানুর রহমান: বৃটিশ শাসনাধীন ভারতের একটা কালো দিন ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখ। ওইদিন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে পঁচিশ হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশের উপর বিনা উস্কানিতে বৃটিশ রাজের সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এটা জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড নামে ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে ২১ বছর পর ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ তারিখে সে সময়ের পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও-ডায়ারকে এক ভারতবাসী হত্যা করেন। হত্যাকারী আর কেউ নন, তিনি রাম মোহাম্মদ সিং আজাদ ওরফে উদম সিং। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ হচ্ছে ৭ একর জায়গার উপর অবস্থিত একটা পার্ক। এই পার্কে সেদিন জনতা এসেছিল রাওলাট আইনের আওতায় অমৃতসরের দুই কংগ্রেস নেতা সাইফুদ্দিন কিসলু এবং ডাঃ স্যুপালের আটকাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।

উঁচু দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত পার্কটির বিভিন্ন কোনায় ছোট ছোট পাঁচটি গেইট ছিল, আর মাঝখানে ছিল একটা বড় গেইট। সেদিন শুধুমাত্র বড় গেটটি ছাড়া বাকিগুলি তালাবদ্ধ ছিল। এর আগে অমৃতসরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত দেখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাইলস আয়ার্ভিং পাঞ্জাবের লেঃ গভর্নরের  কাছে সেনা তলবের অনুমতি চেয়েছিলেন। আই সিএস কর্মকর্তা মাইকেল ও-ডায়ার আসল পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই সেনা বাহিনী নিয়োগের অনুমোদন দেন। একপ্রকার সামরিক শাসনের কায়দায় কর্ণেল রেজিনাল্ড ডায়ারের হাতে জনতা দমনের দায়িত্ব  অর্পিত হয়। দিনটা ছিল পাঞ্জাব প্রদেশে বৈশাখী উৎসব পালনের দিন। উপস্থিত  জনতার  মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি সম্পর্কে কিছু না জেনে কেবল বৈশাখী  উৎসব পালন করতে এসেছিল। কর্ণেল ডায়ার  দুইটি সশস্ত্র  জীপ  আর ৯০ জন সিপাহী  নিয়ে জালিয়ানওয়ালা বাগে উপস্থিত হলে সেনাবাহিনী দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত জনতা পালাবার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে।

তারা ছোট গেইটগুলি বন্ধ দেখে মূল ফটকের কাছে জড়ো হয়। ডায়ার তার অধীনস্থ বাহিনীকে গুলি করার হুকুম দিলে একনাগাড়ে দশ মিনিট ধরে ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চলে। জনতা আহত আর নিহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। সরকারি ভাষ্যমতে, নিহত হয় ৩৭৯ জন আর আহত হন  ১১০০ জন। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ জাতিকে  রক্ষা করার জন্য  হাজার হাজার  ভারতীয় সিপাহী  বিশ্বের নানা স্থানে যুদ্ধ করে তখন সবেমাত্র দেশে ফিরে এসেছে।

তারা দেখলো, কিভাবে বৃটিশ রাজের এক সেনা কমান্ডার আর তার সহযোগীরা ভারতীয় সিপাহীদের আত্মত্যাগের প্রতিদান দিল। বৃটিশ সরকারও বুঝেছিল, তাদের লোকেরা কাজটি ভালো করেনি। কিন্তু শাসক বলে কথা! শাসকদের অনুতপ্ত হতে গিয়ে দুর্বলতা দেখাতে হয় না! অভিযুক্তদের মামুলি শাস্তি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেই সব অপরাধ ভুক্তভোগীরা ভুলে যায়।

এটাই শাসকদের যুগযুগ ধরে লালন করা ধারণা। তারা জানতো, তাদের কাছেই তো ফিরে গিয়ে শাসিতকে বলতে হবে, ভাত দিন, রুটি দিন, শিক্ষা দিন, পদবী দিন!  ইংরেজ জাতির মধ্যে যেমন আছে ব্যক্তি-স্বাধীনতা আর আদর্শের ধ্বজা উড্ডয়নকারী কমনস্ সভা, তেমনি আছে প্রতিক্রিয়াশীল লর্ড সভা; যেমন আছে ফরাসী     বিপ্ল−বের আদর্শ লালনকারী লেখক কবি, তেমনি আছে ‘সাদা মানুষদের বোঝা’নামক অদ্ভুত তত্তে¡ বিশ্বাসী রুডিয়ার্ড কিপলিং এর মত উগ্র জাতীয়তবাদী কবি। 

তিনি  এ দেশের মাটিতেই কাটিয়েছেন বহু বছর, তবু একটুও মমতা দেখাতে পারেননি বিনা অপরাধে গুলিতে আত্মদানকারী ভারতীয়দের জন্য। বরং কর্ণেল ডায়ার এর জন্য সাফাই গেয়েছেন তিনি। লর্ড সভার সদস্যরা  রেজিনাল্ড ডায়ারের প্রশংসা করলেও  কমন্স সভা তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু নামমাত্র শাস্তি  হিসেবে কেবল তার পদোন্নতি বন্ধ রাখা হয়।

অন্যদিকে পাঞ্জাবের দেশপ্রেমিক যুবক উদম সিং এই ঘটনা ভুলতে পারেননি। হত্যার বদলা নিতে ২১ বছর ধরে  তিনি একটি শাস্তি  হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পাঞ্জাবের সাবেক লেঃ গভর্নর মাইকেল ও’ডয়ার তখন অবসর নিয়ে লন্ডনে। বিভিন্ন সামাজিক  সংগঠনের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ  এরকম একটি সংগঠনের এক সভায় কাক্সটন হলে প্রধান অতিথি হিসেবে  ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি।

সেখানে আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিলেন উদম সিং। খুব কাছে থেকে গুলি চালালে তার রিভলবারের দুটো গুলি ও’ ডয়ারের বক্ষ ভেদ করে। ও’ ডয়ার ঘটনাস্থলে নিহত হন এবং সেখান থেকেই উদম সিংকে গ্রেফতার করা হয়। তারপরের ইতিহাস আরো সাহসিকতা আর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে ভরা। জেলে থাকা অবস্থায় চল্লিশ বছর বয়সে উদম সিং উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান-শিখ ধর্ম মিলিয়ে নিজের নাম তৈরি করেন ‘রাম মোহাম্মদ সিং আজাদ’।

বিচারের সময় এই নামেই আদালতে নিজের পরিচয় দিতেন  তিনি। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ ও সামাজিক অন্য পরিচয়ের ঊর্ধ্বে একটি পরিচয় বড় ছিল, তা হচ্ছে হিন্দুস্তানের একজন পরাধীন মানুষ, যে তার দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। ১৯৪০ সালের ৩১ জুলাই  উদম সিংকে ফাঁসি দেয়া হয়।

তখন বিশ্বের অনেক দেশের খবরের কাগজ ফলাও করে উদম সিঙের বিবৃতিসহ ফাঁসির খবর ছাপে।

সেইসাথে ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও তার প্রতি সম্মান দেখানো হয় । কিন্তু ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উদম সিং এর প্রতি সম্মান দেখাতে পারেনি। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন। বৃটিশ সরকার কংগ্রেস আর মুসলিম লীগকে বলেছে, যুদ্ধ শেষ হলে স্ব-শাসন দেয়া হবে। আলাপ-আলোচনায় স্বাধীনতা-প্রত্যাশী ভারতবাসীর কাছে উদম সিংয়ের আচমকা বিপ্লবাত্মক কাজটি বৃটিশ শাসকের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে, এই আশংকা ছিল। 

মহাত্মা গান্ধী বা জওহরলাল নেহেরু কেউই উদম সিঙের হয়ে সেদিন কথা বলতে পারেননি। তারা হয়তো ভেবেছেন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে আরো ভয়ংকর এক দানব জেগে উঠতে চাইছে বিশ্বের বুকে, তাকে ঠেকাতে হবে, উদম সিঙের আবেগের মূল্য দেয়ার মত সময় তখন তাদের কাছে ছিল না।  তবে উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার বহু বছর পর উদম সিং তার সম্মান পেয়েছেন।

১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহেরু উদম সিঙকে একজন বীর বলে উল্লেখ করেন। ১৯৭৪ সালে তার দেহাবশেষ ভারতে এনে শিখ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথাযোগ্য সম্মান দেখায় তৎকালীন ভারত সরকার এবং জালিয়ানওয়ালাবাগেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ক’রে তার দেহভস্ম রাখা হয় সেখানে। ভাবতে অবাক লাগে, যে পাঞ্জাবে সাইফুদ্দিন কিসলু আর স্যুপাল এক হয়ে ইংরেজের নিবর্তনমূলক আইনের বিরুদ্ধে জনতাকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেন এবং একত্রে জেল খাটেন, যে পাঞ্জাবে জন্ম নিয়ে উদম সিং নিজের নাম রাখেন ‘রাম মোহাম্মদ সিং আজাদ’, সেই পাঞ্জাবে দেশভাগের পর সা¤প্রদায়িক দাঙ্গায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়।

এই উপমহাদেশে যুগে যুগে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে কারা উস্কে দিয়েছে, তা এক বিরাট জিজ্ঞাসা। উদম সিং বুঝতে পেরেছিলেন, একদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চলে যাবে, কিন্তু ভারতে থেকে যাবে আরেক অপশক্তি যে জন্ম দেবে সাম্প্রদায়ে-সাম্প্রদায়ে হিংসা আর রেশারেশি। তাই তিনি মহামিলনের আশায় নিজের নামের মধ্যে  খোদাই  করেছিলেন ঐক্যের প্রতীক। তিনি কি সফল হতে পেরেছেন, এ প্রশ্ন আজো এই উপমহাদেশের বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। - সূত্র: অনলাইন

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৯১২৫২২০১৭, ৮৮০-২-৭৯১২৯২১
Email: simecnews@gmail.com