ইউরোপের অন্যতম সুন্দর দেশ মাল্টা
প্রকাশের সময় : 2023-02-01 15:10:53 | প্রকাশক : Administration

জেসিউর রহমান শামীম: গভীর সমুদ্রের মাঝে মাল্টা একটি স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি ইতালির সিসিলি থেকে ৯৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত প্রধান তিনটি বড় দ্বীপ- মাল্টা, গোজো ও কোমিনোসহ পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দেশ। ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে মাল্টার স্বাধীনতা বিল পাস হয়। স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি ‘স্টেট অব মাল্টা’ নামে পরিচিতি পায়। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন রাষ্ট্রটির প্রধান। ১৯৭৪ সালে দেশটি ‘রিপাবলিক অব মাল্টা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রাচীনকাল থেকেই ভৌগলিক অবস্থানের কারণে মাল্টা সবসময় এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। দেশটি বহিঃশত্রু দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছে। ফিওনিশিয়ানস, রোমান, বাইজেন্টাইন এমনকি আরবরাও দেশটিতে তাদের পদচিহ্ন রেখে গেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আজ মাল্টা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক দেশ। এই দেশের আনাচে-কানাচে মাল্টার নীল জলের বুক ছুয়ে ধেয়ে আসা বাতাস হয়তো মাল্টার অতীতের ইতিহাস গুনগুণ করে।
মাল্টার আয়তন ৩১৬ বর্গ কিলোমিটার। যেটি আমাদের পুরো ঢাকা সিটির সমান বলা যায়। ছোট এই দেশটির জনসংখ্যাও মাত্র পাঁচ লক্ষ। মাল্টার রাজধানী ভালেট্টা, এই শহরেরই রয়েছে এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। জানা যায় এই নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে। এই শহরের নামের পেছনে লুকিয়ে আছেন গ্র্যান্ডমাস্টার জ্যঁ প্যারিজো দে লা ভালেট্টার নাম। মূলত তাঁর নামানুসারেই এই শহরের নাম রাখা হয় ভালেট্টা।
ভালেট্টার প্রধান আকর্ষণ দ্য গ্রান্ড মাস্টার্স প্যালেস। নগরীর সবচেয়ে পুরনো ও সুন্দর প্রাসাদগুলোর একটি এটি। তবে এখন প্রাসাদটির একটি অংশ রাষ্ট্রপতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর প্রাসাদের বাকি অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এই প্রাসাদের খুব কাছেই রয়েছে রিপাবলিক স্কয়ার। ভালেট্টায় তৈরি বাড়িগুলো চুনাপাথরের।
মাল্টার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণের নাম চার্চ অব সেন্ট মেরী। বিশ্বের বৃহত্তম গম্বুজওয়ালা স্থাপত্যগুলোর একটি এটি। ১৮৬০ সালে নির্মিত এই চার্চ নিয়ে রয়েছে রূপকথা। শোনা যায়, ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই গির্জার ওপর তিনবার বোমা বর্ষণ হয়েছিল। তার মধ্যে দুটো গম্বুজের ওপর পড়ে অন্যদিকে ছিটকে যায়। আর তৃতীয় বোমাটি যখন পড়ে তখন গির্জার মধ্যে ৩০০ যাজক উপস্থিত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বোমাটি যখন গম্বুজের ওপর পড়ে তা থেকে কোনো বিস্ফোরণ ঘটলো না। গির্জার বাইরের একটি ঘরে বোমাটির একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখা আছে।
মাল্টার সরকারি ভাষা ইংরেজি। তবে এদেশের প্রায় সকলেই মাল্টীয় ভাষাতে কথা বলতে পারেন। এছাড়াও প্রায় ৮০ শতাংশ লোক ইংরেজিতে, ৬৬ শতাংশ লোক ইতালি ভাষাতে এবং ১৭ শতাংশ লোক ফরাসি ভাষায় কথা বলতে জানেন। তবে এসব ছাড়াও মাল্টার স্কুল, কলেজে এখন জার্মান, রুশ এবং স্প্যানিশ ভাষাও শিক্ষা দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
মাল্টার অর্থনীতির মূলে তাকালে এর অতীতের ইতিহাস অনেকটা আঁচ করা যায়। অতীতকালে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বহির্বিশ্বে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো মাল্টা এখনও তেমনি আছে। মাল্টার অর্থনীতির মূলে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য। এ দেশের মানুষের গড় আয় ৪৮ হাজার ডলারের বেশি। পর্যটনই আয়ের প্রধানতম উৎস। দেশটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নৌবাণিজ্যের শিপমেন্ট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। এছাড়া বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও টেক্সটাইল শিল্প এর অর্থিনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাল্টার উপকূলে ছোট্ট এক দ্বীপ গোজো। দ্বীপ মাল্টা হতে ফেরি যোগে যেতে হয় দ্বীপ গোজোতে। গোজোয় রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। ৩,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থাপিত মাল্টার গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন গগন্তিজার মন্দির, প্রিন্সটিন বিচ, ইনল্যান্ড সী ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় দুর্গ, গির্জা আর দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। আর রয়েছে প্রাকৃতিক চুনাপাথরের খিলান দর্শনীয় আজুরে উইন্ডো, যা দ্বীপ গোজোর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এছাড়া শহর জুড়ে মধ্যযুগের অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে।
মাল্টার ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রাবাত। অতীতে যা ছিল রোমান ‘সিটি অব মেলটা’। এখন এটি শহরের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানে রয়েছে সেন্ট পলস শিপরেক চার্চ নামে এক ঐতিহাসিক গির্জা। ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম থেকে ধর্মপ্রচার করতে বেরিয়ে সেন্ট পলের জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। তিনি ভাসতে ভাসতে এখানকার এক দ্বীপে আশ্রয় নেন। জাহাজডুবির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই নির্মিত হয় এই গির্জা। গির্জার চারপাশে সবুজ বাগান, ফুল গাছে ঘেরা সাজানো গির্জার পথ। একপাশে ছোট এক ঝর্ণা থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। যেন এ স্থানে ঐশ্বরিক কোনো দৃশ্য চিত্রায়িত হচ্ছে।
বালুময় বীচ আর স্বচ্ছ নীল জলের সমুদ্র সৈকতে সার্ফিং এবং স্কুবা ডাইভিং করার এক আদর্শ স্থান কোমিনো দ্বীপ। এখানে রয়েছে পাখিদের জন্য সংরক্ষিত এক অভয়ারণ্য। প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য এ অঞ্চলটিকে ন্যাচারাল রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই দ্বীপে গাড়ি চলাচলের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তাই কোথাও রাস্তাও নেই। পায়ে হেঁটেই দ্বীপটিতে ঘুরে বেড়াতে হয়।
কোমিনো দ্বীপের আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান ব্লু গ্রাটো। চুনাপাথরের এক পাহাড়। হলুদ মাখানো সাদা পাথরের পাহাড়ে হালকা নীল সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে। অনন্তকাল ধরে জলের ঢেউয়ে নরম চুনাপাথর ক্ষয় হয়ে পাহাড়ের মধ্যে তৈরি করেছে বেশ কয়েকটি ছোট বড় গুহা। উজ্জ্বল সূর্য কিরণে জলের ঘন নীল রং প্রতিফলিত হচ্ছে গুহার মধ্যে, আবার সেই হলদে আবীর মাখা সাদা পাথরে আলো সমুদ্রের নীল জলের ওপর প্রতিবিম্ব তৈরি করছে। পাহাড়ের গুহা রক থ্রাশ পাখিদের আবাসস্থল। সেই পাখি দেখার আশায় কত শত পর্যটক ছোট ছোট নৌকোয় চড়ে সেই পাহাড়ের কাছে পৌঁছোয়।