বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের হৃদয়
প্রকাশের সময় : 2023-03-15 15:53:12 | প্রকাশক : Administration

মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তিনি সাম্যভিত্তিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো গড়ার অঙ্গীকার করেন। নারীর ক্ষমতায়ন, নগর ও গ্রামের বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের মতো অঙ্গীকারগুলোও লিপিবদ্ধ করা হয় ওই সংবিধানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জারক রসে সিক্ত ওই সংবিধানের আলোকেই তিনি বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্র্ষিক পকিল্পনা ও অর্থনৈতিক নীতিকৌশল নির্ধারণ করেন।
আর তাই ১৯৭৪ সালে অকাল বন্যায় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহযোগিতা বন্ধের কারণে বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তা মোকাবেলার জন্যে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এ সময়টায় তিনি সর্বক্ষণ ছট্ফট করতেন। দুবেলা ঠিক মতো ভাতও খেতেন না। অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষের কষ্ট ভাগ করে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। গাফ্ফার চৌধুরিকে তিনি বলেছেন (সমকাল ১৭/৩/১৮): ‘গাফ্ফার তুমি বিশ্বাস করবে, এই দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে না পারলে আমি আত্মহত্যা করব ভেবেছিলাম। করিনি কেন জানো? আমি একজন মুসলমান। আত্মহত্যা করা ইসলাম ধর্মে মহাপাপ। দ্বিতীয়ত, বাংলার মানুষের আমার প্রতি বিশ্বাস আছে। আমি তাদের ফেলে রেখে বিশ্বাসহন্তার কাজ করতে পারি না।’ সেই বিশ্বাস তিনি রেখেছিলেন। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পঁচাত্তরেই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ফসল ফলানোর ডাক দিয়েছিলেন। ঐ বছরই বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। প্রশাসনের বিকেন্দ্রায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচুর অভিযোগ ছিল যা তিনি সুযোগ পেলেই প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৭৩ সনে গণভবনে গাফ্ফার চৌধুরিকে তাঁর লেখা একটি কবিতার কথা জানিয়েছিলেন। গাফ্ফার ভাই জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে’কবিতার অনুরূপ এক কবিতা লেখেন বঙ্গবন্ধু। ‘আমার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে/বাংলার ভদ্রলোকেরা শুধু চুরি করে, পোটলা বাঁধে।’১৯৭৫ এর ২৬ মার্চ সোহওরাওয়ার্দী উদ্যানে তাই তিনি বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? আমার শ্রমিক দুর্নীতিবাজ? ...ওরাই মালিক, ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।... আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? অফিসার করে কে? কার টাকায়? বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়।’তাই শিক্ষিত জনদের বলেছেন ‘ওদের ইজ্জত করুন।’আর প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনি দিচ্ছেন কি? কি ফেরত দিচ্ছেন?’ সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর অন্তর সর্বক্ষণ কাঁদতো। এই আবেগমথিত ভাষণই তার বড় প্রমাণ।
১৭ মার্চ ১৯৭১। ধানমন্ডি ৩২ নং সড়কের বাড়িতে। বিদেশি সাংবাদিকদের জন্ম দিনের শুভেচ্ছার উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন যে কেউ ভাবতে পারেন না মরার কথা তখনো তারা মরে। যখন কেউ ইচ্ছে করে তখনো তাদের মরতে হয়।... আমার আবার জন্মদিন কি, মৃত্যুদিবসই বা কি? আমার জীবনই বা কি? মৃত্যু দিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।’
১৯৫৩-৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে বঙ্গবন্ধু প্রার্থী ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ খানের নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহের নান্দাইল গিয়েছিলেন। কর্মীদের সাথে ডাক বাংলোয় উঠেছিলেন। মশারি ছিল না। ছিল একটি কাঁথা। মাঝরাতে তিনি গাফ্ফার চৌধুরিকে সেই কাঁথাটি দিয়ে জড়িয়ে দিলেন। টের পেয়ে তা ফেরত দিতে গেলে গাফ্ফার চৌধুরিকে তিনি বলেন, ‘বাংলার মশা আমাকে কামড়াবে না।’
বাংলার মশা না কামড়ালেও, এদেশেরই কিছু ষড়যন্ত্রকারী কু-সন্তান অতর্কিতে হামলা করে ‘বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’কে শারীরিকভাবে তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের কালরাতে। এর পরের দিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট লন্ডনের‘দ্যা ফাইনেন্সিয়াল টাইমস’ লিখেছিল, ‘এই করুণ মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে অবধারিত ছিল তাহলে বাংলাদেশের জন্মের মোটেই প্রয়োজন ছিল না।’
এর কয়েকদিন পরে ২৮ আগস্ট বিবিসির সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারন ‘দি লিসনার’পত্রিকায় ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে উচ্চতর আসনেই অবস্থান করবেন। তাঁর বুলেটবিদ্ধ বাসগৃহটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্মারকচিহ্ন’এবং কবরস্থানটি ‘পুণ্যতীর্থে’পরিণত হবে।’তাঁর সেই ভবিষ্যৎবাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। তাঁকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মনে চির দিনের জন্যে গেঁথে দিতে হলে তাঁর মৌল চাওয়াগুলোর আলোকে আমাদের দেশকে সুশাসনের চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। দুর্নীতি, বঞ্চনা, অন্যায্যতা, অবিচার যেন সমাজের অলি-গলিতে অবাধে বিচরণ না করতে পারে সেজন্যে মানবকল্যাণধর্মী গরিব- হিতৈষী বঙ্গবন্ধুর ভাবনাসমূহকে আমাদের চলার পথের পাথেয় করতে হবে। পুরো জাতির মনে তাঁর সুদূরপ্রসারি কল্যাণ ভাবনা চিন্তার আলোকে কাক্সিক্ষত মুক্তির দিশা দিতে হবে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তা সত্ত্বেও একথা বলা যায় যে বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ডানা ঝাপ্টা দিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য বাংলাদেশ। তথাকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উপচে পড়ছে সমৃদ্ধির ফসল। আমাদের নিরন্তর সজাগ থাকতে হবে যেন আমাদের অবহেলায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এবং অপরিণামদর্শিতার কারণে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের এই উন্নয়নের অভিযাত্রা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়।
আমাদের নিরন্তর শুভকর্মের মাধ্যমেই প্রকাশ করে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আর তা করতে পারলেই শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তাঁকে আমরা অনুভব করতে পারবো আমাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। আর উচ্চারণ করতে পারবো মহাদেব সাহার ভাষায়, ‘এই নাম স্বতোৎসারিত। তুমি বাংলাদেশের হৃদয়।’ - লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
