অনেকদিন লেখা হয়না ওদেরকে নিয়ে

প্রকাশের সময় : 2019-03-27 18:15:07 | প্রকাশক : Administration
অনেকদিন লেখা হয়না ওদেরকে নিয়ে

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ দিন কত দ্রুত যায়! মনে হয় এই তো ক’দিন মাত্র আগে আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। অথচ আর ক’দিন বাদে আমার শোনিমই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সবে স্কুল পড়ুয়া শোনিমের স্কুলের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিই আগ্রহ বেশী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা নিয়ে তার নানা প্রশ্ন; নানা জিজ্ঞাসা। জানতে চায় নানান কিছু। ওর জানার উদ্দেশ্য অবশ্য ভিন্ন। ওর ধারনা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানে, আনন্দ করে সারাক্ষণ ঘুরে ফিরে কাটানোর জীবন; পড়াশুনা না করে ফুরফুর করে পাশ করার জীবন।

বাস্তবে এমনটা না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আসলেই আনন্দের। খুবই মধুর। কষ্ট কিংবা তিক্ততার ছোটখাট অভিজ্ঞতা থাকলেও আনন্দের জীবন নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। থাকতে পারেও না। আমাদের সময়ে আমরা দেশে কিংবা বিদেশে বেহিসাবীর মতই আনন্দ করেছি। সে সবই আজ মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার প্রথম দিককার কথা। একেকটা দিনের সূর্য্য উঠতো এত্ত এত্ত আনন্দ আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে। বিচিত্র সে সব অভিজ্ঞতা। মনে হতো পুরো জাপানটাই এক বিচিত্র দেশ।

বিচিত্র তো বটেই। বিচিত্র এর সকল অবয়ব, বিচিত্র এর আচরণ। যতই দিন গেছে ততই টের পেয়েছি। টের না পেয়ে উপায়ও ছিল না। বৃত্তি ছাড়া পড়তে গিয়েছি। যাকে বলে নিজের টাকায় বেশ কষ্ট করে পড়া। বড় সাহসী পদক্ষেপ। সেই সময়টায় বাহার ভাইয়া জাপানে ছিলেন বলেই সাহসটা পেয়েছিলাম। তবে আমার সুপারভাইজিং প্রফেসারও খুব হেল্পফুল ছিলেন। না হলে আমার খবর হয়ে যেত! সাংঘাতিক অমায়িক টাইপের ভদ্রলোক তিনি। প্রায় বিনামূল্যে থাকার জন্যে প্রফেসরস্ কোয়ার্টারে বাসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

আমার তো খুশীতে লাফিয়ে গাছে ওঠার অবস্থা। তবে না লাফিয়ে প্রথম রাতটা লম্বা ঘুমে কাটিয়ে দিলাম। মালামাল শুণ্য বাসায় চোখ যখন মেললাম সূর্য্য তখন ঠিক মাথার উপরে। বাইরের দরজা মেলে আমার চোখ তো চড়কগাছ। একগাদা মালামালে ভরা আমার বাসার সামনা। সাথে ছোট একটা চিরকুট। গোটাগোটা অক্ষরে ইংরেজীতে লেখা আমার প্রফেসরের নোট;

“ভার্সিটির প্রথম সকালে তোমাকে স্বাগতম। জানি না প্রথম রাতটা তোমার কেমন কেটেছে! তবে সামনের রাতগুলো তোমার ভাল কাটবে আমি নিশ্চিত। বৃত্তি নিয়ে আসতে পারোনি বলে খুব বেশী ভেবোনা। জাপানে টাকার অভাবে কারো পড়াশুনা বন্ধ হয় না। এখানে তুমি একা নও।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি যতদিন আছো, ততদিন আমি তোমার পাশেই আছি।”

তিনি আরো লিখেছেন, “রেখে যাওয়া মালামালের প্রায় সবই সাংসারিক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসাদি। আমার স্ত্রী ভেবেচিন্তে কিনেছে তোমার জন্যে। নতুন সংসার তোমার। সবই তোমার লাগবে। সবই তোমার জন্যেই আনা। কেবল ওয়াশিং পাউডারের প্যাকেটগুলো ছাড়া। ওসব আশেপাশের প্রতিবেশীদের জন্যে। ঘুম থেকে জাগবার পরে তুমি প্রতিটি বাসায় যেয়ে একেকটা প্যাকেট উপহার হিসেবে দেবে। আর দেবে নিজের পরিচয় এবং বলবে এখন থেকে তুমি তাদের নতুন প্রতিবেশী।”

এত্ত এত্ত মালামাল পেয়ে আমি খুব খুশী হলেও অবাক হয়েছি ঢের। অবাক হয়েছি নতুন মানুষ হয়ে পূরানো প্রতিবেশীদের উপহার দেবার অদ্ভুত এই কালচার দেখে। একদিন সুযোগ বুঝে জানতে চাইলাম এর মাহাত্ম। প্রফেসর ইয়ামাশিরো বললেন, “এটা জাপানীজ ট্র্যাডিশন। যুগযুগ ধরে চলে আসা সমাজের কালচার। কেউ যখন কোন নতুন জায়গায় বাসা নেয়, এভাবেই কাপড় ধোয়ার গুঁড়ো সাবান আশপাশের অতিথিদের উপহার হিসেবে দিয়েই বাসায় ওঠে। নতুন বাসায় সংসারের সব মালামাল নিয়ে ওঠা মানে এর আশেপাশের সব বাসার মানুষকে ধূলো ময়লার মাঝে ফেলা। বাসা শিফটিং করবে তুমি আর ধূলো ময়লা খাবে অন্য লোকে; এটা হয় কিভাবে? তাই বিনয় আর দুঃখ প্রকাশের প্রতীক স্বরূপ সামান্য এই উপহার প্রথা। ব্যাপারটি এমন যেন, বাসা শিফটিং এর জন্যে যা কিছু ময়লা প্রতিবেশীর কাপড়ে লাগবে, ওয়াশিং পাউডার দিয়ে সব ধূয়ে দেবে। সহমর্মিতা প্রকাশের সামান্য চেষ্টা বলতে পারো।”

আমি অবাক বিষ্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। কী অদ্ভুত সুন্দর কথা; অদ্ভুত সুন্দর কালচার! নিজের কাজে অন্যের বিরক্তি কিংবা অসুবিধার ব্যাপারে জাপানীজ জাতি প্রচন্ড রকমের সচেতন। তাই সব সময় লক্ষ্য একটাই। কোন ভাবেই নিজের কাজে অন্যের সমস্যা সৃষ্টি করা যাবে না । অন্যকে বিব্রত করা যাবে না। এমনকি স্বামী-স্ত্রী পর্যন্ত সতর্ক থাকে যাতে একের জন্যে অন্যকে কোনভাবেই বিব্রত হতে না হয়।

কাউকে বিব্রত করাকে ওরা হারাম মনে করে। এটা যে কোন দম্পতির মোবাইল ব্যবহারের ধরণ দেখলেও বোঝা যায়। বাইরে তো বটেই, বাসায় ফিরেও কেউ মোবাইল ফোন রিং মুডে রাখে না। স্বামী-স্ত্রী দু’জনার ফোনই বাসায় থাকা অবস্থায়ও সাইলেন্ট মুডে থাকে। কেবল স্বামী-স্ত্রী নয়, ওদেশে ১০০% মোবাইল ব্যবহারকারী সাইলেন্ট মুডে ফোন চালায়। লক্ষ্য একটাই; রিংটোন কোনভাবেই কেউ যেন না শোনে। ফোন আসবে স্বামীর কাছে, আর রিংটোন শুনবে বউ; এটা হতে পারেনা।

কখনো হতে দেখিওনি, শুনিওনি। যার বিষয়, কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। আমাদের দেশের মত ওদেশেও হরহামেশা লোকজনের সর্দি-কাশি লাগে। তবে একবার লাগলে আর রক্ষে নেই। নিজেকে আড়াল করার বা ঢেকে রাখার সে কী প্রাণপণ প্রচেষ্টা। সারাক্ষণ মুখে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরবে। লোকের সামনে হচরফচর সর্দি বের করবে না। বা খুক্কুর খুক্কুর কাশিও দেবে না। আর কফ যদি বেরিয়ে আসেই, টিস্যু পেপার মুখে রেখে পেঁচিয়ে পকেটে ভরে রাখবে।

এসব কাজে ওদের হাত চলে দ্রুত। হাত কোথায় চলে না! হাত দোকানেও চলে। বিক্রিত পণ্যের মূল্য রেখে দোকানীকে যদি খুচরা পয়সা ফেরত দিতে হয়, তাহলে সেটা দেবে অতীব সাবধানে। খুচরো কয়েন ফেরত দেওয়ার সময় দোকানী এক হাত আপনার হাতের নিচে রাখবে যাতে কয়েন পড়ে না যায়। কয়েন পড়ে গেলে ক্রেতার অসম্মানী হয়। কোনভাবেই ক্রেতাকে অসম্মান করা কিংবা বিব্রত করা যাবে না। ক্রেতার সন্তুষ্টি সকল সময় অগ্রগণ্য।

ক্রেতাকে বিনয় ছাড়া আর কিচ্ছু দেখানো যাবে না। জাপানীরা জাতিগত ভাবেই প্রচন্ড বিনয়ী। দোকান ও রেস্তোরায় কর্মীরা আপনাকে নত হয়ে আন্তরিক অভিবাদন জানাবে। দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দোকানি দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বিদায় জানাবে। এমনকি জাপানি প্রযুক্তিগুলোও বিনয়ে সাজানো। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ট্যাক্সির দরজা খুলে যাবে। মুখ ফোটে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলতে হবে না, এই ট্যাক্সি যাবে? যাত্রী কোথায় যাবে এটা জিজ্ঞেস করার কোন অধিকার ট্যাক্সি ড্রাইভার রাখে না, যতক্ষণ না যাত্রী গাড়ীতে উঠে বসে। হয়ত লিফট আসার অপেক্ষায় আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। এক সময় লিফট আসবে। কিন্তু আপনাকে অপেক্ষায় রাখার জন্যে লিফট বারবার আপনার কাছে ক্ষমা চাইবে।

যেন ক্ষমা চাইবার জন্যেই জাপানী জাতির জন্ম। এই বিনয় এবং ভদ্রতা জাপানীজদেরকে আজকে এ অবস্থায় এনেছে। উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। উন্নতি হয়েছে অর্থে; উন্নতি বিত্তে এবং আচার ব্যবহারে। তিন বৈশিষ্টের এমন মোহময় সমন্বয় অন্য কোন জাতিতে নেই। পৃথিবীতে ওরাই একমাত্র আইডল। হয়ত তাই গর্বিত জাপানী জাতি নিজেদেরকে মনে করে অনন্য; বিশ্বের সেরাদের সেরা।

সেরা কিনা জানি না। ওদের দাবীটি সত্যি কিনা সেটাও জানি না। সবই জ্ঞাণীদের বিচার্য বিষয়। তবে ওদের বিনয়, ভদ্রতা বিচারের উর্দ্ধে; অসম্ভব প্রশংসার দাবীদার। এবং অনুকরণীয়। প্রচন্ড রকমের অন্যের জন্যে অনুকরণীয়। বিশেষ করে আমাদের জন্যে তো বটেই। একটি সুস্থ, সুন্দর সমাজ গঠনের জন্যে ওদের সব ভাল বৈশিষ্টগুলো আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দেয়া খুব জরুরী। খুব বেশী না হোক, একটু একটু করে ছড়াতে পারলেও কেবল বাংলাদেশই নয়, গোটা পৃথিবীটাই একদিন বসবাসের জন্যে অধিকতর যোগ্য হয়ে উঠবে।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৯১২৫২২০১৭, ৮৮০-২-৭৯১২৯২১
Email: simecnews@gmail.com