বঙ্গোপসাগর নাম যেভাবে হলো
প্রকাশের সময় : 2019-06-13 18:01:17 | প্রকাশক : Administration

সিমেক ডেস্কঃ বঙ্গ+উপ+সাগর = বঙ্গোপসাগর। অর্থাৎ ‘বঙ্গ দেশের উপসাগর’ বা ‘বাংলাদেশের উপসাগর’। তবে ‘বঙ্গ দেশের উপসাগর’ বলাই শ্রেয়; কেননা এর সাথে কলকাতা বা পশ্চিম বাংলারও সংযোগ রয়েছে। তাছাড়া দেশভাগের আগে উভয় বাংলা তো এক সাথেই ছিল। কিন্তু জটিলতাটা শুরু হয় অন্য জায়গায়।
বঙ্গোপসাগরের সাথে তো আরও অনেক দেশ বা অঞ্চলের সংযুক্তি রয়েছে, যেমন- মায়ানমার, ভারত, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড; আরও রয়েছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ফলে অনুসন্ধিৎসু মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বঙ্গোপসাগরের নাম তাহলে ‘মায়ানমার উপসাগর’, ‘ভারত উপসাগর' বা ‘শ্রীলংকা উপসাগর’ ইত্যাদি হলো না কেন?
প্রথম কথা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরের নামকরণের পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। তবে সেই কারণটা কী তা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। তবুও বঙ্গোপসাগরের নামকরণের পেছনে আমরা তিনটি অনুমান ধরে নিতে পারি।
প্রথমত, প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের নামানুসারেই বঙ্গোপসাগর নামকরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে বঙ্গোপসাগরের নাম উল্লে−খ থাকায় এমন নামকরণ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের মানুষের এমন কোনো বীরত্বগাঁথা ছিল যার কারণে তাদের সম্মানার্থে বা প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের নামকরণ বঙ্গোপসাগর করা হয়েছে।
বঙ্গ অঞ্চলের নামানুসারেই বঙ্গোপসাগর নামকরণ করা হয়েছে। সাধারণভাবে এই অনুমানটিই অধিকাংশ মানুষ সঠিক মনে করে, কেননা ‘বঙ্গ+উপসাগর’ নামটি ‘বঙ্গ’ থেকে এসেছে এটা ধরে নেয়াই সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক।
অনেক ঐতিহাসিক এই অনুমানকেই সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাদের মতে, সেই বীরত্বগাঁথা হচ্ছে- বঙ্গ এলাকায় অত্যন্ত সাহসী ও যোগ্যতাসম্পন্ন নাবিকদের জন্ম হওয়া। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বহু আন্তর্জাতিক নাবিকের জন্ম হয়েছে। এখানকার নাবিকরা শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, বরং সারা বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলাদেশ কেবল মাত্র নদীমাতৃক নয়, সমুদ্র তীরবর্তী দেশ। বঙ্গোপসাগরের নাম যে দেশের নামানুসারে হয়েছে সেই দেশ একদা সমুদ্র যাত্রায় অগ্রণী ছিল। ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর- এসব নাম অকারণে রাখা হয়নি। যারা রেখেছিল তারা পৃথিবীর নাবিক সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে বাঙালি গণ্যমান্য ছিল।
প্রকৃতপক্ষে, তারা পৃথিবীর অন্য দেশের মতোই প্রাচীন ব্যবসায়ী। পশ্চিম, দক্ষিণ এবং পূর্বে সমুদ্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় তারা নৌ-চালনায় অভ্যস্ত ছিল এবং সমুদ্রগামী নৌযানের সাহায্যে অতলস্পর্শ সমুদ্র যাত্রা করতো। প্রকৃতপক্ষে আরবকে জাহাজের পরিচালক, নাবিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ব্যক্তিদের দ্বারা পূর্ণ একটি দেশ হিসাবে গণ্য করা হতো। ভারত এবং নিকটবর্তী এশিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য চলাচলের প্রধান রাস্তা ছিল সম্ভবত আরব সাগরের মধ্য দিয়ে। তারা ভারতের উপকূলবর্তী প্রতিটি শহর ও ভারতীয় দ্বীপসমূহ স্পর্শ করে অনুসরণ করতো। তাদের নৌযানসমূহ প্রায়শঃ বঙ্গোপসাগর ও বঙ্গদেশের ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে আসামের অভ্যন্তর ভাগেও পৌঁছাতো।
এভাবে তারা বঙ্গদেশ বা বর্তমান বাংলাদেশে আগমন করতো। প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দর ছিল, সেখানে আরব বণিকগণ আসতেন। তাদের জাহাজে কাজ করার সুবাদে এখানে অসংখ্য সাহসী নাবিক তৈরি হয়েছিল। খুব কম সময়ে তারা অত্যন্ত দূরদর্শী ও যোগ্যতাসম্পন্ন নাবিকে পরিণত হতে পারতেন বিধায় আরবগণ সহসাই তাদের সাথে নিতেন। আর তাদের কারণে বঙ্গোপসাগরের নাম বঙ্গোপসাগর হয়ে যেতে লাগল। এই নাম তৎকালীন নাবিকদেরই দেয়া।
ইতিহাসবিদ আনিসুল হক চৌধুরী তার ‘বাংলার মূল’ গ্রন্থে লিখেছেন: অতঃপর বঙ্গদেশের নামানুসারে বঙ্গোপসাগরের নাম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করিলেও দৃষ্ট হয় যে বঙ্গদেশের নাবিকদের তথা তাহাদের আরবীয় নাবিক পূর্ব পুরুষদের সমুদ্র পথে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় বঙ্গোপসাগরে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করিবার কারণেই অন্য কোনো দেশের নামে না হইয়া বঙ্গদেশের নামেই বঙ্গোপসাগরের নাম হইয়াছে।
