যদি আমরাও পারি...
প্রকাশের সময় : 2019-07-11 18:12:38 | প্রকাশক : Administration

মোঃ শফিকুল হক আকন্দঃ বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা আর বিক্ষিপ্ত কিছু ভাবনা কিছুদিন ধরে মাথার ভিতর ঘোরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কোনভাবেই হিসাব মিলাতে পারছিনা তাই প্রবাস জীবনের অনেক ঘটনার মধ্যে অল্প দুয়েকটি ঘটনা আজকে শেয়ার না করে পারলাম না। বাস্তব জীবনে আমি অনেকটা ইন্ট্রোভার্ট, নিজের মতো করে থাকতে ভালবাসি; তাই অনেক কিছু শেয়ার করার থাকলেও সাধারণত করিনা। তবুও আজকে খুব ইচ্ছা হলো কিছু বলতে।
ঘটনা-১: আমি আগেও শেয়ার করেছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পরীক্ষার সময় হয় তখন চারদিকে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখা যায় যেমন; প্রতিটি ছাত্রের কাছে মানসিক ডাক্তার ইমেইল করবে, জানতে চাইবে আমরা কি খুব stressed? Do you need any special assistance? লাইব্রেরী গুলোতে student union building এ পর্যাপ্ত পরিমান ফ্রি ফল; স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়ার খেলনা, ফ্রি কাগজ, কলম, পোষা প্রানীকে আদর করার ব্যবস্থা। চা, কফি চকোলেট সহ নানা ধরনের ব্যবস্থাও থাকে।
আজকে লাইব্রেরীতে ঢোকার সময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের নবনির্বাচিত tudent Union এর দুইজন প্রতিনিধি কফি, চা, চকোলেট, ডায়েরী, বিস্কুট নিয়ে লাইব্রেরীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশ দিয়ে যাবার সময় চরম বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাস করল would you like to have a cup of coffee? আমি জিজ্ঞাস করলাম এগুলো কেন? উত্তরে বলল ছাত্রদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে পাশে থেকে কিছুটা সাহায্য করার জন্য আমাদের সামান্য চেষ্টা। আমি বললাম, can I have a cup of coffee please? খুব খুশি হয়ে আমাকে কফি বানিয়ে দিল। তারপর বলল, Have a nice day! See you. আমার মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল; ছাত্র নেতারা এত বিনয়ী কিভাবে হতে পারে? আমরা কেন পারিনা?
ঘটনা-২: আমার শরীর খারাপ হওয়াতে এদেশের সরকারী ডাক্তার (জিপি) এর কাছে যাই। আমার জিপি ৪০-৪৫ বছর বয়স্ক একজন আইরিশ মহিলা ডাক্তার। তার চেম্বারে নক করার পর Yes! Come in বলার পরিবর্তে নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন। ডাক্তার জানালেন আমার একটা অসুখ ধরা পরেছে। যার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমার চোখে আতংকের চিহ্ন দেখে ডাক্তার আমার সাথে যে ব্যবহার করেছিল আমি তা জীবনে ভুলব না। তার চেম্বারেই আমি ৫০% সুস্থ্য হয়ে যাই। পরম মমতা নিয়ে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে চিন্তা করতে না করলেন; এগিয়ে দিলেন দরজা পর্যন্ত। আমি চিন্তা করে কুল কিনারা করতে পারলাম না। সম্পূর্ণ অচেনা একজন কালো মানুষের দিকে এত ভালবাসার উৎস কোথায়? আমাকে এত সময় দিয়ে মানসিক সাপোর্ট না দিলে কী হতো?
ঘটনা-৩: আমার বাচ্চাদের নিয়ে নিউক্যাসল থেকে ট্রেনে করে লন্ডন যাচ্ছি। মন খুব খারাপ; কারন ওরা আমাকে রেখে চলে যাচ্ছে। পথিমধ্যে ট্রেন ম্যানেজার (টিটি) আসল। আমি টয়লেটে থাকায় আমার ছোট ছেলে ফান করে বলল Oh you can't find the ticket. Because our tickets are in the bathroom. ট্রেন ম্যানেজার ফানটা বুঝতে পারল আর আমার বাচ্চাদের কথায় খুব মজা পেয়ে ওদের সাথে গল্প শুরু করল। ওদের টিকেটে ছোট্ট একটা ছবি একে দিল।
যখন শুনল ওরা আজকেই ইংল্যান্ড ছেড়ে যাচ্ছে তখন বলল আমি কাজ শেষ করে তোমাদের সাথে আবার দেখা করব। একটু পর আমি ট্রেনের খাবারের কামরায় কফি কেনার জন্য গেলাম। কফির বিল দিতে গিয়ে শুনলাম আমার বিল নিবেনা। সেই সাথে জানাল ট্রেনের ম্যানেজার আমার বাচ্চাদের জন্য চকোলেট, চিপস এগুলো রেডি করে রেখেছেন। আমি চিন্তা করতে লাগলাম আমার দেশে আফ্রিকান কোন পরিবারের সাথে আমি কি এই ব্যবহার করতে পারতাম?
সব দেশেই ভাল খারাপ দুটিই আছে। আমাদের দেশের অনেকেই কেন জানি ভালটাকে গ্রহন না করে খারপটার দিকেই বেশী ধাবিত হই। খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি আমার মাতৃভূমিতে কিছু কিছু মানুষ একটু ক্ষমতাধর চাকুরী করলে ক্ষমতার দাপটে মাটিতে পা ফেলতে চাননা। অন্য কোন পেশার মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করেন না। একটু নামিদামি বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়লেই অশিক্ষিত মানুষকে তুই তোকারি করে কথা বলে। কারও পকেটে কিছু বাড়তি টাকা থাকলেই বিত্তহীন মানুষদের সাথে শো অফ করতে থাকে।
আমরা কেউ একবার ভাবিনা এসবই দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। এসব অর্থ ও ক্ষমতার অহংকার খুবই ক্ষণস্থায়ী। সকলে সকলের সাথে কাঁধ মিলিয়ে যদি যার যার কাজটি মানবীয় গুনাবলী দিয়ে সততার সাথে পালন করতে পারি তবেই আমাদের অফুরান সম্ভাবনার দেশকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে পারব।
