অধঃপতন

আল মারুফ: সুমিকে আমি বিয়ে করেছিলাম বাবা মায়ের পছন্দেই। কিন্তু বিয়ের পর বুঝতে পারি ওর ভিতরে বেশ কিছু খারাপ দিক বিদ্যমান। এর মধ্যে সবথেকে প্রধান দিক ছিলো সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকা। তাছাড়া নিজেতো ঘরের কাজ কিছু করতোই না উল্টো বড়দের মতো আমার মা কে এটা ওটা এনে দেবার জন্য হুকুম করতো। আমার মা ছিলেন একেবারেই পানির মতো সাদাটে মনের মানুষ তাই তিনি সুমিকে নিজের বউয়ের চোখে কখনোই দেখেননি। বরং মেয়ের মতো রাণীর আসনে বসিয়ে খাওয়াতেন। এসব দেখে আমাদের প্রতিবেশীরাও মাকে নিয়ে তামাশা করতো। কিন্তু আমার মা এতোটাই সরল মনের মানুষ ছিলেন যে প্রতিবেশীদের কটু কথার তোয়াক্কা না করে তিনি সুমির সাথে এতোটাই অমায়িক আচরণ করতেন যে কখনোই যাতে সুমি কোনো ঝগড়ার ক্লু খুঁজে না পায় তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে যেতেন। কারণ আমার মায়ের ধারণা ছিলো যে, এক হাতে তালি বাজেনা তাই দুনিয়ায় যত বউ শাশুড়ীর ঝগড়া লাগে তাতে বউয়ের যদি দোষ থাকে তবে শাশুড়ীরও অল্পস্বল্প দোষ আছেই। আমি মাঝেমধ্যেই আমার মাকে নিয়ে ভাবি যে যদি তাকে শান্তশিষ্ট কোনো শাশুড়ীর প্রতিযোগীতায় দাঁড় করানো হয় তবে নিশ্চিন্ত মনে নোবেলটা তাঁর হাতেই আসবে।

সুমির এসব উচ্চাভিলাষী কর্মকান্ডের জন্য আমি যে কিছু বলিনা তা কিন্তু নয় বরং মাঝে মধ্যে নরম ভাষায় না বুঝলে ঝাড়িও দেই। কিন্তু ও আমার ঝাড়ি শুনে এমন আচরণ করে তাতে মনে হয় যেন আমার ঝাড়িটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে ফেলেছে। ওর এমন ব্যবহারের দরুন আমার মনে বেশ জেদ চেপে বসলেও কখনো ওর গাঁয়ে হাত তুলতাম না। কারণ একদিকে যেমন মায়ের রাণী ছিলো অপরদিকে ছিলো সুমির একরোখা টাইপের ব্যবহার। আমার মার খেয়ে কখন যে কী করে ফেলে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

সেদিন আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে আমার শাশুড়ী আর সুমির বড় ভাই তাঁর স্ত্রীসহ বেড়াতে এসেছিলেন। তখন সুমির ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিলো সে যেন রাণী থেকে এখন মহারাণী হয়ে গিয়েছে। অথচ সুমির ভাবি ঠিকই মেহমানের মতো আচরণ না করে রান্নাঘরে ঢুকে আমার মাকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। সুমির ভাবিকে দেখে আমার মনে মনে শুধু এই আফসোসটাই হচ্ছিলো,

-ঈশ, আমার বউটা এমন কেন হলোনা?

আমি তখন সুমির পরিবারের সামনে সুমিকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। কারণ আমি জানতাম ওর এই অধঃপতনের পিছনে আমার শাশুড়ীই দায়ী। কারণ প্রতিবারই যখন সুমিকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম তখন আমার শাশুড়ী সুমিকে শিখিয়ে দিতেন যে, সব কাজ শাশুড়ীকে দিয়ে করাবি। এই নিয়ে বেশি তিড়িংবিড়িং করলে জামাইকে বলবি আলাদা বাসা নিতে। এসব শুনে দেখবি তোর শাশুড়ী এমনিতেই সোজা হয়ে গেছে।

এসব কথোপকথন আমি আড়াল থেকে শুনে ফেললেও তখনও তেমন কিছু বলিনি কিন্তু শ্বশুর বাড়ি যাওয়া অনেকাংশেই কমিয়ে দিয়েছিলাম। এতকিছু সত্ত্বেও আমার শাশুড়ী ঠিকই তার ছেলের বউকে গাধার খাটুনি খাটাতেন।

সেদিন রাতে যখন খাবার খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎই সুমি মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-মা! ইদানিং আপনার রান্নায় বেশিরই স্বাদ পাওয়া যায়না। একটু ভালোভাবে মসলা পাতি দিয়ে রান্না করবেন তাহলে স্বাদটাও জোশ হবে।

সুমির এমন বক্তব্য শুনে মা নিশ্চুপ শ্রোতার ভূমিকা পালন করলেও আমি আর নিজের রাগটাকে প্রশমিত করতে পারলাম না বরং সজোরে প্রথমবারের মতো সুমির গালে চড় বসিয়ে দিলাম। আমার এমন কান্ডে স্বভাবতই সুমি আর মা অনেকটা হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণেই আমি নিজের মনে জেদ সঞ্চয় করে বলে উঠলাম,

পারলে নিজে রান্না করে খাও। তোমার এত বড় সাহস, আমার মায়ের হাতের রান্না খাও আবার বলো রান্না ভালো হয়নি। তোমার মতো মেয়ে বিয়ে না করে যদি গ্রাম থেকে একটি মেয়েকে বিয়ে করতাম তাহলে অন্তত আমার মাকে এভাবে চাকরের মত খাটতে হতোনা।

আমার এমন ধারালো বক্তব্য শুনে সুমি আর একমুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়েই রুমে চলে গেলো। আর এদিকে সুমিকে চড় দেবার ফলস্বরূপ আমার মা অনবরত আমাকে বকেই চলছেন। কোনোরকম অর্ধেক খাবার শেষ করে রুমে যেতেই দেখি সুমি কাপড় চোপড় ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। আমি খানিকটা কৌতূহল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাপড় গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

আমার কথার জবাব না দিয়ে সুমি রুম থেকে হনহন করে বের হয়ে গেলো। আমার মা বেশ কয়েকবার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও সফল হলোনা উল্টো আমি বললাম,

মা যেতে দাও। দেখবা সময়মতো ঠিকই আবার এসে উপস্থিত হবে।

আমার কথাটা যেন সুমির আরেকটু গায়ে লাগলো তাই হুরহুর করে বের হতে আর বেশি দেরী করলোনা। শ্বশুর বাড়ির দূরত্ব আমার বাসা থেকে খুব বেশি নয় তাই সুমিকে নিয়ে বেশি চিন্তা হলোনা।

কেঁটে গেছে পনেরো দিন; কিন্তু এখনো শ্বশুর বাড়ি থেকে সুমির আসার নাম নেই। এমনকি আমি ওকে নিয়ে আসতেও গিয়েছিলাম কিন্তু কোনো এক কারণে সুমি বরাবরই আমাকে অপমানিত করে বের করে দিতো। এমনকি আমার শাশুড়ী বলতো,

-তোমার সাহসতো কম না আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলে এখন আবার আমার মেয়েকে নিতে এসেছো? যদি তোমার মাকে সহ নিয়ে এসে ওর নিকট মাফ চাইতে পারো তবেই কেবল সুমি তোমার বাড়িতে যাবে।

শাশুড়ীর এমন বক্তব্য শুনে আমার আক্রোশের মাত্রাটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। যেখানে তার মেয়ে আমার শিকলে আবদ্ধ সেখানে কিনা তারাই উল্টো আমাকে মাফ চাইতে বলে? সবকিছু বিবেচনা করে দেখলাম যে সুমিকে নিয়ে আসতে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে।

আমার চাচার মেয়ে মিমি আমাকে সেই ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু ওর বয়স আমার থেকে অনেক কম হওয়ায় বাবা মা তখন আমাকে ওর সাথে বিয়ে দেননি। তাই এবার আর সুযোগটা হাত ছাড়া করলাম না বরং সুমিকে ফিরিয়ে আনার জন্য মিমির সাথে পালিয়ে বিয়ে করার মিথ্যা অভিনয় সাজালাম। আর এই ঘটনা শুধু মিমি আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলাম। আমার পরিকল্পনা ছিলো সুমি এসব শুনে নিশ্চই বাড়িতে ফিরে আসবে আর তখন ওকে সব সত্যটা খুলে বলবো দরকার হলে মাফও চাইবো। যখন সুমির বাড়িতে খবর রটে  গেলো যে আমি আরেকটা বিয়ে করেছি তখন আমার ধারণাকে মাটি চাপা দিয়ে উল্টো ওরা একমুহূর্ত দেরী না করে আমাকে এবং আমার মায়ের নামে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে দিলো।

বাড়িতে মিছিলের মতো লোক সমাগমে সম্পূর্ণ ভরপুর হয়ে গেছে। একপাশে আমি এবং আমার পরিবার আরেকপাশে সুমি আর তার বাবা মা এবং আমাদের অভিমুখে বসে আছে থানার ওসি ও তার কিছু সহকর্মী। হঠাৎই সুমি অনেকটা কান্নার অভিনয় করে বললো, স্যার, ওদের বাসায় বিয়ের পর থেকে যতদিন ছিলাম ততদিন আমাকে গাধার খাটুনি খাটিয়েছে। সামান্য বিশ্রাম পর্যন্ত নিতে দিতোনা বরং প্রতিদিন কোনো খুঁত পেলেই গায়ে হাত তুলতো। সেদিন যখন মার সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে যাই তখন আমাকে নিয়ে না এসে উল্টো দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।

সুমির এমন বক্তব্যে শুধু আমি কিংবা আমার পরিবারই নয় বরং আমাদের প্রতিবেশীরাও হতভম্ব হয়ে গেলেন। তৎক্ষনাৎ মিমি বলে উঠলো,

স্যার, মারুফ ভাইয়ার সাথে আমার কিছুই হয়নি বরং ভাবিকে যখন ভাইয়া নিয়ে আসতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলো তখন আমরা বিয়ের অভিনয় করি যাতে এটা শুনে ভাবি চলে আসেন। ভাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছে।

মিমির সাথে সাথে এক এক করে সবাই সুমির বিপক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে। ওসি সাহেব একসাথে এতোগুলো মানুষের কথা শুনে স্বভাবতই আমার শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করলেন,

কী ব্যপার? এখন কী আপনার মেয়ের কথা বিশ্বাস করবো নাকি এতোগুলো মানুষের কথা?

ওসি সাহেবের এই বক্তব্য শুনে আমার শাশুড়ী অনেকটা পেঁচার ন্যায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন। এই ঘটনার মাঝে হঠাৎই আমার মা কোথা থেকে যেন একটি ডিভোর্স পেপার এনে চোখে অশ্রু নিয়ে বললেন,

-তুই এক্ষণি এই ডিভোর্স পেপারে সাইন কর। যেই মেয়েকে কখনো আমি রান্নাঘরে ঢুকতে দেইনি সেই মেয়ে যেহেতু আজ আমাকে এতো বড় অপবাদ দিলো ওর সাথে তুই জীবনেও সুখি হতে পারবিনা।

আসলেইতো যেই মেয়েকে তিনি রাণীর আসনে বসিয়ে খাইয়েছেন সেই মেয়েই কিনা আজ মায়ের নামে এতবড় অপবাদ দিলো? এসব ভেবে আর একমুহূর্ত দেরী না করে ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিলাম। এরপর সুমি জনসম্মুখে মায়ের পা ধরে অজস্র আকুতি করেও মায়ের মন ভাঙ্গাতে পারলোনা আর আমার মনতো সেই কবেই পাথর হয়ে গিয়েছে।

কেটে গেছে দুইবছর...

এরপর সবার সম্মতিতে আমি মিমিকে বিয়েও করেছি আর সত্যি কথা বলতে আমার মাকে এখন আর চাকরের ন্যায় থাকতে হয়না। বরং তিনি উল্টো রাণীর ন্যায় বসে বসে খান। আজ খুব করে আফসোস হয় যে মিমিকে আমি কেনো প্রথমবারেই বিয়ে করলাম না?

সেদিন রাস্তায় হঠাৎই সুমির ভাইয়ের সাথে দেখা। সুমির ভাই নিজেই আগবাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তথ্যসূত্রে জানতে পারি তিনি নাকি ভাবিকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। কারণ নিজের বউয়ের উপর মায়ের এতো অত্যাচার আর সহ্যই করতে পারছিলেন না। অপরদিকে সুমিরও নাকি অন্য জায়গাতে বিয়ে হয়েছে কিন্তু সেখানে সে আগের মতো রাণীর মর্যাদায় সমাসীন নয় বরং চাকরের ন্যায় তাকে বাস করতে হয়। বেশ কয়েকবার অত্যাচারের দরুন বাপের বাড়ি চলে আসলেও আমার প্রাক্তন শাশুড়ী জোর করেই আবার সেখানে পাঠিয়ে দেন।

এসব ঘটনা শুনে আমার অন্তরটা অজানা এক আনন্দে কয়েকবার আন্দোলিত হয়েছিলো বটে তবে খারাপও লেগেছিলো এই ভেবে যে, অনেক ভালবাসার পরেও সে বুঝেনি।

“সুমি তুমি স্বর্ণ চিনতে ভুল করেছিলে তাই তোমার এই অধঃপতন। তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো সুখ জীবনে একবারই আসে আর সেটার যদি যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারো তবে তোমাকে সারাজীবন ঐ দুনয়নের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে পরকালের ট্রেন ধরতে হবে। আর ইহাই ভবিতব্য।।” - সংগৃহিত

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com