রেস
আনোয়ার সেলিম: সেদিন ফাল্গুন মাসের কোনো এক সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বিকাল আনুমানিক পাঁচটা। হঠাৎ আমার মোবাইলে রং নাম্বারে কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠ। অচেনা। কোনো ধরনের ভূমিকা ছাড়াই জানতে চাইল-
আচ্ছা, আপনার কি গাড়ি আছে?
বললাম- আছে।
অচেনা একটা মেয়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে আমার মধ্যে কেন জানি কোনো ভাবান্তর হলো না। খুব স্বাভাবিকভাবে কথোপকথন চালিয়ে গেলাম। যেন খুব চেনা কারও সঙ্গে কথা বলছি-
-আপনি কি নিজে ড্রাইভ করেন?
হুম।
কি গাড়ি আপনার?
-হোন্ডা ফিট
-মেক?
-২০০৪
-কী কালার?
-স্কাই ব্লু।
-আমার টয়োটা আইএসটি। এটারও মেক ২০০৪। সিলভার এ্যাশ।
-বাসা কোথায় আপনার?
-ধানমন্ডি ছয়।
-কাজ আছে কিছু এখন?
-না।
-এক কাজ করেন
-কী?
-মানিক মিয়া এভিনিউ টিএন্ডটি অফিসের সামনে গাড়ি নিয়ে চলে আসেন। কতক্ষণ লাগবে?
-বিশ মিনিট।
-আমার বাসা ইন্দিরা রোড। আমার লাগবে পাঁচ মিনিট। আমি ওখানে অপেক্ষা করব। আপনি আমার গাড়ির ঠিক পেছনে এসে থামবেন।
-আচ্ছা।
ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যে এসে থামলাম টয়োটা গাড়িটার পেছনে। সম্ভবত রিয়ার-ভিউ মিররে দেখছিল। থামতে না থামতে ফোন এলো। আমরা এখন একটা রেস দেব। এয়ারপোর্টের গোল চত্বর পর্যন্ত। আপনি সামনে যান। রেস শুরু করেন।
আমি এগিয়ে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে পাশ কাটিয়ে তীব্র বেগে তার গাড়িটা সামনে চলে গেল। বিজয় সরণির সিগন্যালে দুজনকেই থামতে হলো। আমি আগে সে পিছে। আমরা কেউ কারও চেহারা দেখছি না। এরপর আর কোনো সিগন্যালে দাঁড়াতে হয়নি। হুস করে আমার পাশ দিয়ে প্রবল বেগে ছুটে মুহূর্তে উধাও! আমি রণেভঙ্গ দিলাম। কি দরকার বাবা! কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম কে জানে। শেষে না আবার জীবনটাই খোয়াতে হয়।
আমি এয়ারপোর্ট গোল চত্বরে ইউ-টার্ন নিচ্ছি। তখন ফোন এলো।
কোথায় আপনি?
ফিনিশিং লাইন ক্রস করছি।
ভালো ড্রাইভার তো! এই গাড়ি চালান! আমি সেই কখন ফিনিশিং লাইন ক্রস করলাম! আমি রেডিসন হোটেলের সামনে পার্কিংয়ে অপেক্ষা করছি। সোজা চলে আসেন। পাশের পার্কিংটা খালি আছে।
১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি পার্ক করে নেমে দাঁড়ালাম। নিজের গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মেয়েটা। পরনে সুতি সালোয়ার কামিজ। শারীরিক গড়নে নিখুঁত সুন্দরী একটা মেয়ে। আমাকে দেখেই বলল-‘রেসে তো হেরে গেলেন’। বললাম-‘হুম’।
বলল-আমার সঙ্গে আসুন। সে অতি সামান্য এগিয়ে যেন আমি তাকে অনুসরণ করছি।
হোটেলের লবী পেরিয়ে পুল সাইডে এসে থামল। আশপাশটা নির্জন। আমাকে বলল-জুতা জোড়া খুলবেন একটু? এই প্রথম বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-কেন?
‘পানিতে পা ভেজাব’ বলেই নিজের স্যান্ডেল খুলে পানিতে পা-জোড়া নামিয়ে দিল। পা দোলাতে দোলাতে গুনগুন করে গান গাইছে মেয়েটা। আমি বললাম-এভাবে পুলে পা নামিয়ে বসা কি ঠিক হচ্ছে! হোটেলের লোকজন বাধা দেবে না? বলল-না। এখানে সবাই আমাকে চেনে। আপনি না হয় আসন করে আমার পাশেই বসুন। আমি তাই করলাম।
মেয়েটা গান গাইতে গাইতে বলল আজ পূর্ণিমা। তারপর আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-বহুদিন পর পূর্ণিমা দেখছি। প্রায় আধাঘণ্টা ওখানে বসে নানান কথা হলো। কখনো গলা মিলিয়ে ‘তোমার হাওয়া হাওয়ায়....।
এবার উঠা যাক। আমি আপনাকে কফি খাওয়াব। আমরা উঠে লনের চেয়ারে বসলাম মুখোমুখি। এসপ্রেসো কফি আর ব্রাউনি অর্ডার করা হয়েছে। মেয়েটার হাসি অসাধারণ। দাঁত উঁচা-নিচা মেয়েগুলা যখন হাসে তখন তাদের চোখ মুখের সঙ্গে যেন ভুবন হাসতে থাকে। মেয়েটা তেমন করেই হাসছে সারাক্ষণ। সন্ধ্যা সাড়ে আটটা। বলল-এবার উঠতে হবে। আপনার ফোন নাম্বার আমার কাছে থাকল। রাতে কথা হবে।
ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে ফেসবুক আইডি লিখে দিয়ে বলল, “একটা অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেবেন।” রাত সাড়ে ১০টা। কল এলো মেয়েটার।
‘আচ্ছা! আজকের ঘটনায় আপনি অবাক হননি’?
আমি বললাম-না। আমি সহজে অবাক হই না।
আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেন না যে!
আমি জানতাম আমার অনাগ্রহ দেখে আপনি নিজেই বলার জন্য অস্থির হবেন।
আপনি ভীষণ ইন্টেলিজেন্ট। আচ্ছা আপনি কি ভাবছেন আমি আপনাকে চিনতাম?
না। চিনতেন না।
তারপরও কৌতূহল দমাতে পারলেন?
হুম।
গাড়িটা আমার নিজের উপার্জন দিয়ে কেনা। সে জন্য এটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমার স্বাধীনতাও বলতে পারেন। আচ্ছা আমার বয়স কত বলতে পারেন?
বড়জোর ছাব্বিশ কি সাতাশ।
আপনার অনুমান ভালো। ছাব্বিশ প্লাস। আপনার বয়স অনুমান করব?
না থাক।
না। বলেই ফেলি ত্রিশ-একত্রিশ?
একদম ঠিক আছে। আমাকে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন?
না। কথা শেষ হলে পাঠাব। একটা শর্ত আছে-একসেপ্ট করে যা খুশি দেখে নেবেন। চব্বিশঘণ্টা পর ডিলিট করে দেব।
হেসে বলল-কেন? ঘরে বউ আছে? বলতে হবে না।
আপনাকে আমার ব্যাপারে জানাতে ইচ্ছা করছে। শুনুন...
আমার বিয়ের মাত্র চার মাস হলো। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু সে আমার রেকলেস ড্রাইভিং মোটেও পছন্দ করে না। ছোটবেলা থেকে গাড়ি নিয়ে আমি ভীষণ সিরিয়াস। আমি স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে আমি নিজে ইনকাম করে গাড়ি কিনব। এটা এক রকম আমার জেদ। টিভিতে কার রেস দেখতাম খুব। বাবার নিজস্ব গাড়িতে চড়ে আসছি; কিন্তু সেটার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল না। আমার চাই নিজের গাড়ি। পড়াশোনায় আমার তেমন মন ছিল না। তারপরও পাসকোর্সে বিএ পাস করে মাত্র বাইশ বছর বয়সে একটা লিজিং কোম্পানির চাকরিতে ঢুকলাম। চার বছরের মধ্যেই ম্যানেজার হয়ে গেলাম। আমার চাকরির জমানো টাকা আর কমিশন থেকেই গাড়িটা কেনা। এটা আমার সন্তানের মতো।
আমার স্বামীর যত আপত্তি আমার এই গাড়ি! গত পরশু তার সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে এসেছি। ভাবলাম সব রাগ ভুলে আমাকে নিতে চলে আসবে। এলো না। দু’দিন ধরে আমার মন খারাপের পারদ তুঙ্গে উঠেছে।
আজ বিকালে বড্ড অস্থির লাগছিল। কি করব বুঝতে না পেরে ফোনটা হাতে নিয়ে অচেনা নাম্বারে কল করে মানুষদের জ্বালাতন করার একটা ফন্দি মাথায় ঢুকল। অপর পাশে কে ফোন ধরবে ঠেলাওয়ালা না মুদি এসব কিচ্ছু ভাবিনি। কোন টাইপের মানুষ ফোন রিসিভ করলে কি বলব তাও ভাবিনি। আপনি ফোন রিসিভ করার পর নাম্বার দেখে মনে হলো পোস্ট-পেইড। পুরোনো এবং সাধারণভাবে করপোরেট লোকজন ব্যবহার করে। আপনার কণ্ঠ শুনে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কোত্থেকে যেন গাড়ি আর রেসের ব্যাপারটা চলে এলো! কিন্তু কি অবাক ব্যাপার! আমার পাগলামির সঙ্গে সব এভাবে ঠিকঠাক মিলে গেল! এক নিমিষে কথাগুলো বলে গেল মেয়েটা।
ফোন রেখে ফেসবুক নিয়ে বসলাম। বেশকিছু জমকালো বিয়ের ছবি। যুগল ছবিতে দেখলাম তার হাজব্যান্ড বেশ সুদর্শন। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। মেয়েটার নাম নিশাত। প্রায় আট-নয় মাস পর এক বিকালে হঠাৎ নিশাতের ফোন। বলল- আজকের বিকালটা কী সুন্দর! দেখেছেন সৌরভ? ইচ্ছা করছে সেদিনের মতো আবার আপনার সঙ্গে রেস দেই। যদিও সেটা সেদিনের মতো ততো এক্সাইটিং হবে না। কিন্তু আমার... থাক।
সেদিনের ফোনালাপের পর আরও সাত-আট মাস কেটে গেছে। হঠাৎ একটা শপিং সেন্টারে মুখোমুখি দেখা। স্বামীর কোলে প্রায় ছ’মাসের ফুটফুটে ছেলে। নিশাত প্রায় চিৎকার করে উঠল-‘সৌরভ’! আসো পরিচয় করিয়ে দেই। আমার হাজব্যান্ড ‘জয়’। আমার জানের টুকরা ‘দীপ’। আর ইনি হচ্ছেন ‘সৌরভ’-যার কথা তোমাকে বলেছিলাম। সেই যে এক বিকেলের ফেল্লু রেসার। কথাটা বলার সাথেই প্রদীপ নিভে যাওয়ার মতো নিশাতের মুখ কে যেন গ্রাস করলো। ফরমাল কুশল বিনিময়ের পর দুই পক্ষ উল্টা দুই দিকে রওনা দিয়েছি। পেছনে তাকাতেই চোখাচোখি! তার চোখে প্রগাঢ় মেঘ-ছায়া আর আমার ভেতরে গভীর শ্বাস। জীবনের রেস। উল্টা পথে দূরে সরে যাওয়া! - সূত্র: ইত্তেফাক